কলকাতা থেকে কালকা:
শতাব্দী প্রাচীন কালকা মেলে ৪৯ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট!
সঠিক সময়ে ট্রেন ছাড়বে কি না ঠিক ছিল না। তবে ‘প্রভু’র কৃপায় টিকিট কনফার্মড ছিল চার মাস আগে থেকে। ১২৩১১ আপ হাওড়া-দিল্লি-কালকা মেল। স্লিপার ক্লাস, মাথা পিছু ৬৮০ টাকা। আমরা দুই, আমাদের দুই। ২ খুদের একজন ১২-র ওপরে, একজন নীচে। এখন খুদেদের বয়স ১২-র ওপরে হলে বড়দের মতো পুরো ভাড়া। ১২-র নীচে হলে অর্ধেক ভাড়ায় টিকিট মিলবে, কিন্তু রাতে শোয়ার বার্থ মিলবে না। প্রত্যেকের আলাদা বার্থ নিতে চাইলে ৫ বছরের ওপর হলেই পুরো ভাড়া।
আমাদের এবারের গন্তব্য কালকা হয়ে সিমলা-কুলু-মানালি।
কলকাতা থেকে সিমলা যাওয়া যায় অনেক ভাবে। কিন্তু ৩২ ঘণ্টা ৫০ মিনিট ট্রেন জার্নি করে কালকা হয়ে সিমলা যাওয়ার আকর্ষণ ছিল দুটো। এক, দেড় শতাব্দী প্রাচীন কালকা মেল, আর দুই, কালকা-সিমলা রুটের শতাব্দী ক্লাস শিবালিক ডিলাক্স এক্সপ্রেস। এই লেখায় রইল কালকা মেলে চড়ার অভিজ্ঞতার কথা।
কোনও এক অজানা জায়গায় দাঁড়িয়ে কালকা মেল। ছবি - লেখকের তোলা |
কালকা মেল ভারতীয় রেলের ইতিহাসে সব থেকে পুরনো ট্রেন। ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কোম্পানির হাত ধরে ১৮৬৬ সালে হাওড়া থেকে শুরু প্রথম যাত্রা। ডেস্টিনেশন ছিল দিল্লি। নাম ছিল ‘ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে মেল’। অনেকে সংক্ষেপে বলতেন ‘আপার ইন্ডিয়া’। হাওড়া থেকে ছাড়া ট্রেনের নম্বর ছিল ১ আপ। ফিরতি ট্রেন, ২ ডাউন। চালু হওয়ার দু’বছরের মাথায় তৎকালীন ভাইসরয় ল্যান্সডাউন নির্দেশ দেন, গ্রীষ্মে কলকাতায় না থেকে শৈলশহর সিমলা থেকে দেশ চালাবেন। যেমনি বলা, তেমনি কাজ। সিমলাকে গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার। ঠিক হয়, দিল্লি থেকে নিয়ে যাওয়া হবে কালকা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে ‘ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে মেল’টিকেই। ১৮৯১ সালে ট্রেনের যাত্রাপথ দিল্লি থেকে সম্প্রসারিত হয় হরিয়ানার কালকা পর্যন্ত। কারণ, সিমলা যাওয়ার গেটওয়ে ছিল কালকা। গ্রীষ্মের দাবদাহ শুরু হতে না হতে ইংরেজ শাসকরা যখন লোকলস্কর ও তল্পিতল্পা নিয়ে কলকাতা থেকে সিমলা পাড়ি দিতেন, তখন তাঁদের ভরসা ছিল এই ট্রেন। পুরো ট্রেন ভর্তি করে শাসক ও সরকারি কর্মীরা রওনা হতেন সিমলা। আবার ট্রেন ভর্তি করে ফিরে আসতেন গ্রীষ্মের শেষে। ভাইসরয় চড়বেন বলে হাওড়া স্টেশনে ৮ ও ৯ নম্বর প্ল্যাটফর্মের মাঝে এবং কালকা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে তৈরি করা হয় দু’টি ক্যাবওয়ে। যাতে ভাইসরয় গাড়িতে চড়ে এসে সোজা ট্রেনের কামরায় উঠতে পারেন, হাঁটতে না হয়। পরে ‘ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে মেল’-এর নাম হয় কালকা মেল। ১৯৯০ সালে রেলের নম্বরে বড়সড় বদল আসে। ১ আপ-এর বদলে আপ কালকা মেলের নম্বর হয় ১২৩১১ এবং ২ ডাউনের বদলে ডাউন ট্রেনের নম্বর হয় ১২৩১২।
ইতিহাসে যার এত নাম, সেই ট্রেনের দুর্নামও কম নয়। দুর্নাম মূলত তার বিলম্বিত লয়ের জন্য। তাই টিকিট কনফার্মড থাকলেও শুরু থেকে চিন্তায় রেখেছিল কালকা মেল। কারণ, নানা কারণে ক’দিন ধরে বেশ কয়েক ঘণ্টা দেরিতে যাতায়াত করছিল সে। সন্ধে ৭টা ৪০-এ ছেড়ে আপ কালকা মেল-এর কালকা পৌছনোর কথা তৃতীয় দিন ভোর ৪টে ৩০-এ। আমাদের ট্রেন কবে পৌঁছবে কে জানে! আশঙ্কাই সত্যি হল। রওনা হওয়ার দিন দুপুরে 139-এ AD 12311 এসএমএস করতেই উত্তর এল, আপ কালকা মেল ৬ ঘণ্টা ২০ মিনিট লেট! ছাড়বে রাত ২টোয়!!
রাত দেড়টা নাগাদ ৯ নম্বর প্ল্যাটফর্মে এল কালকা মেল। কোচ নম্বর এস ১২। একেবারে সাধারণ কামরা। তবে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। শৌচাগারও খারাপ নয়। হাতের কাছে মোবাইল ফোন চার্জের পয়েন্ট। বসার সিট, খাওয়ার টেবিল ঠিকঠাক।
রাত ২টোতেই ছাড়ল ট্রেন। শুরুর ৬ ঘণ্টা ২০ মিনিটের বিলম্বিত লয় লম্বা হতেই থাকল... হতেই থাকল...
শুধু পুরনোই নয়, ভারতীয় রেলের ইতিহাসে সব থেকে লম্বা ট্রেনও কালকা মেল। মোট ২৪টি কামরা। ১১টি স্লিপার, ২টি এসএলআর, ৩টি সাধারণ, একটি প্রথম শ্রেণি বাতানুকূল, ৩টি থ্রি টিয়ার এসি, ৩টি টু টিয়ার এসি এবং একটি প্যান্ট্রি কার। চারটি রেক। সুপার ফাস্ট এই ট্রেনের সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১১৫ কিলোমিটার। ইঞ্জিনের ক্ষমতা ৬ হাজার ৩৫০টি ঘোড়ার শক্তির সমান। কিন্তু ট্রেন ছাড়া থেকে সেই অশ্বশক্তির পরিচয় পাওয়াই গেল না!
ঘণ্টাখানেক জেগে থাকার পরই বিছানা পাতার তোড়জোড় শুরু। বিছানা, চাদর আবার কী রকম হবে কে জানে! প্যাকেট খোলার আগে কপালে চওড়া চিন্তার ভাঁজ। কিন্তু খুলে দেখলাম- না, প্রায় নতুন চাদর, বেডশিট, পরিস্কার বালিশ, কম্বল। থ্যাঙ্কস সুরেশ প্রভু...
রাতের ঘুমটা খারাপ হয়নি। সকালে উঠে জানালা দিয়ে দেখলাম, বাইরে ফুটফুটে সকাল। কামরার মধ্যে প্যান্ট্রি কারের কর্মীদের আনাগোনা। কালকা মেলে প্যান্ট্রি থাকলেও খাবারের খরচ টিকিটের সঙ্গে ধরা থাকে না। আলাদা খাবার কিনে নিতে হয়। সেখানেই মুশকিল। ভাত, ডাল, তরকারি, আলু সেদ্ধ, আচার ১৬০ টাকা! চিকেন নিলেই ১৮০!! বলতে বাধা নেই, খাবারের মান দামের তুলনায় খুবই খারাপ। কিন্তু কী আর করা যাবে!
হাওড়া থেকে কালকার মধ্যে ৩৭টি স্টেশনে দাঁড়ায় কালকা মেল। ট্রেনের টাইম টেবল অনুযায়ী যেখানে, মুঘলসরাই পৌঁছনোর কথা সকাল ৬টা ২৫-এ, সেখানে তার থেকে ৪০০ কিলোমিটার আগে ধানবাদেই ফুটল সকালের আলো। যমুনা পেরোতেই বিকেল পার! ইলাহাবাদ জংশনে পৌঁছনোর কথা সকাল ৯টা ২৫-এ, যখন পৌঁছলাম তখন বিকেল ৪টে ২৩....! সময়ে চললে কালকা মেল দিল্লি পৌঁছয় দ্বিতীয় দিন রাত ৮টা ৪৫-এ, আমাদের ট্রেন পৌঁছল তার পরের দিন দুপুর ২টো ৩১-এ!! দিল্লি থেকে কালকার দূরত্ব তখনও ৩০২ কিলোমিটার।
মহানিষ্ক্রমণের পথে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু গোমো থেকে কালকা মেলেই উঠেছিলেন। ইতিহাসে শুধু নয়, কালকা মেল ঠাঁই করে নিয়েছে সাহিত্যেও। সত্যজিত্ রায়ের ‘বাক্স রহস্য’ গল্পের পটভূমি তো কালকা মেল। এই ট্রেনে সফর করাকালীন ধনি ব্যবসায়ী দিননাথ লাহিড়ীর একটি বাক্স হারিয়ে যায়। আসলে বাক্সটি বদল হয়ে যায় সিমলাবাসী এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। দিননাথ লাহিড়ী প্রদোষচন্দ্র মিত্র ওরফে ফেলুদাকে নিয়োগ করেন হারিয়ে যাওয়া বাক্স উদ্ধারে। তদন্ত করতে গিয়ে ফেলুদা, তোপসে ও জটায়ু খুঁজে পান বাক্সে ছিল বিখ্যাত ভূপর্যটক শম্ভুচরণ বোস লিখিত তিব্বত সম্পর্কে অপ্রকাশিত ভ্রমণকাহিনী। সেই পাণ্ডুলিপির সন্ধানে সিমলা রওনা দেন তিন মূর্তি। শেষমেশ দীর্ঘ চড়াই উতরাই পেরিয়ে উদ্ঘাটিত হয় বাক্স রহস্য।
কালকা স্টেশন। রেলের ঘড়িতে তখন ভোর ৪টে ৩। ছবি - লেখকের তোলা |
সত্যজিতের গল্প টানটান গতিতে এগোলেও সুরেশ প্রভুর কালকা মেল শুরু থেকেই হারিয়ে ফেলেছিল তার গতি। শেষ পর্যন্ত লেট বেড়ে দাঁড়াল ১৭ ঘণ্টায়! কথা ছিল, দ্বিতীয় দিন ভোর সাড়ে ৪টেয় আমাদের কালকা পৌঁছনোর। কিন্তু কেউ কথা রাখেনি....। আমরা কালকা পৌঁছলাম তৃতীয় দিন রাত ৯টা ৩৫-এ। ১৭ ঘণ্টা ৫ মিনিট লেট-এ! ৪৯ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট জার্নি করে!!
অগত্যা রেলওয়ে ক্যান্টিনের ভাত-ডাল-তরকারি খেয়ে কালকা স্টেশনের ওয়েটিং রুমে রাত্রিবাস। ভোরের হেরিটেজ ট্রেন শিবালিক ধরে রওনা হব সিমলা। এক ইতিহাসের সাক্ষী হওয়ার পর আর এক ইতিহাসের অপেক্ষা!
সেই আনন্দেই ভুলে গেলাম ১৭ ঘণ্টা লেট জার্নির যন্ত্রণা!!
------------------------
শেষ কথা -
খুব দরকার না পড়লে কালকায় সাধারণত কেউ থাকে না।
থাকতে চাইলেও অসুবিধা নেই। রেল স্টেশনের বাইরে প্রচুর হোটেল আছে। ৭০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা প্রতি রাত্রি, অনেক ভাল হোটেল পেয়ে যাবেন। আর ঘুরতে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন কালী মন্দির বা পিঞ্জর গার্ডেন। সপ্তদশ শতকে তৈরি পিঞ্জর গার্ডেন হল কালকার বিখ্যাত জায়গা। প্রকৃতিপ্রেমীদের প্রিয়। প্রতি বছর গ্রীষ্মকালে এখানে বসে আমের মেলা। প্রায় ৫০০ রকমের আম আসে মেলায়। গার্ডেনের মধ্যে আছে নার্সারি, মিনি চিড়িয়াখানা, জাপানি গার্ডেন, পিকনিক স্পট। আর হিন্দু দেবী মা কালীর মন্দিরও বিখ্যাত কালকায়। ২২ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশের এই মন্দিরে নবরাত্রি উপলক্ষ্যে প্রতি বছর ভিড় করেন বহু পুণ্যার্থী। এলাকার মানুষের বিশ্বাস, অজ্ঞাতবাসের সময় পাণ্ডবরা এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
Kalka @ a glance-
Kolkta to Kalka Distance - 1743km
(Journey date - 9th to 11th December, 2016)
Location - Kalka, Panchkula District, Haryana, IndiaElevation - 658 metres (2,159 ft)
Railway Station Code - KLK
Ph no. 01733-225088
- Subscribe: https://www.youtube.com/c/RAJATKANTIBERA
- Blog: http://rajatkb.blogspot.com
- Google Plus: https://plus.google.com/u/0/
- Linkedin: https://www.linkedin.com/in/rajatkanti-bera-275134139/
- Facebook: https://www.facebook.com/rajatkanti.bera
No comments:
Post a Comment