আশ্বিনের শারদ প্রাতে...
বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির...
শিউলি ঝরা সকাল...। ছবি - লেখকের তোলা |
‘আশ্বিনের মাঝামাঝি উঠিল বাজনা বাজি,
পূজার সময় এল কাছে।’
আকাশে-বাতাসে-কাশে তাঁর আগমনী বার্তা।
‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে / বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির /
ধরনীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা /
প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত /
জ্যোতির্ময়ী জগতমাতার আগমন বার্তা...’
‘মহালয়া’ শব্দের সন্ধি বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় মহান+আলয় = মহালয়৷ সঙ্গে স্ত্রীকারাত্মক ‘আ’ যুক্ত হয়ে ‘মহালয়া’৷ ‘মহ’ শব্দের দু’টো অর্থ। ‘মহ’ বলতে বোঝায় পূজা, ‘মহ’ বলতে বোঝায় উৎসব। মহ+আলয় = মহালয় হচ্ছে পূজা বা উৎসবের আলয় বা আশ্রয়। আলয় শব্দের একটি অর্থ আশ্রয়। অন্যদিকে ‘মহালয়’ বলতে ‘পিতৃলোক’কে বোঝায়। যেখানে বিদেহী পিতৃপুরুষের অবস্থান। তাই যদি হয়, তাহলে পিতৃলোককে স্মরণের অনুষ্ঠানই হল মহালয়া। সনাতন ধর্ম অনুসারে এই দিনে প্রয়াত আত্মাদের মর্ত্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, প্রয়াত আত্মার যে সমাবেশ হয় তাহাকে মহালয় বলা হয়। মহালয় থেকে মহালয়া। এই দিনটি পিতৃপূজা ও মাতৃপূজার পরম লগ্ন৷ কিন্তু তাহলে শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ হল কেন? কারণ, পিতৃপক্ষের অবসানে, অমাবস্যার অন্ধকার পেরিয়ে আমরা যখন আলোকময় দেবীপক্ষের আগমনকে প্রত্যক্ষ করি, সেই মহা লগ্ন আমাদের জীবনে ‘মহালয়ার’ বার্তা বহন করে আনে। এক্ষেত্রে স্বয়ং দেবীই সেই মহান আশ্রয়, তাই উত্তরণের লগ্নটির নাম মহালয়া।
মহালয়া পক্ষের পনেরোটি তিথি হল প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী ও অমাবস্যা। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা প্রতিপদ থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী অমাবস্যা পর্যন্ত সময়কে বলে পিতৃপক্ষ৷ হিন্দু মহাকাব্য অনুযায়ী, সূর্য কন্যারাশিতে প্রবেশ করলে পিতৃপক্ষ সূচিত হয়। শাস্ত্র মতে, ব্রহ্মার নির্দেশে দেবীপক্ষের আগের কৃষ্ণা প্রতিপদে মর্ত্যে নেমে আসেন পিতৃপুরুষেরা৷ অপেক্ষা করেন, উত্তরসূরীদের কাছ থেকে জল পাওয়ার৷ তাই বিশ্বাস, এই সময় কিছু অর্পণ করা হলে তা সহজে তাঁদের কাছে পৌঁছয়৷ সূর্য বৃশ্চিক রাশিতে প্রবেশ করে, তাঁরা পুনরায় পিতৃলোকে ফিরে যান। গোটা পক্ষকাল ধরে পিতৃপুরুষকে স্মরণ করে তর্পণ করা হয়৷ যার চূড়ান্ত প্রকাশ বা মহালগ্ন হল মহালয়া৷ মহালয়ার দিন অমাবস্যায় পূর্বপুরুষের উদ্দেশে জলদানই হল তর্পণ৷ অনেকেই এই দিনটিকে দেবীপক্ষের সূচনা বলে থাকেন৷ এটি বহুল প্রচলিত ভুল ধারণা৷ মহালয়া পিতৃপক্ষের শেষ দিন৷ পরের দিন শুক্লা প্রতিপদে দেবীপক্ষের সূচনা৷ সেই দিন থেকে কোজাগরী পূর্ণিমা পর্যন্ত ১৫ দিন হল দেবীপক্ষ৷
মহাভারতে কাহিনি অনুসারে, প্রসিদ্ধ দাতা কর্ণের মৃত্যুর পর তাঁর আত্মা স্বর্গে গেলে, তাঁকে স্বর্ণ ও রত্ন খাদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়। কর্ণ ইন্দ্রকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে ইন্দ্র বলেন, কর্ণ সারা জীবন স্বর্ণই দান করেছেন, তিনি পিতৃগণের উদ্দেশ্যে কোনওদিন খাদ্য প্রদান করেননি। তাই স্বর্গে তাঁকে স্বর্ণই খাদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। কর্ণ বলেন, তিনি যেহেতু তাঁর পিতৃগণের সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না, তাই তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁদেরকে স্বর্ণ প্রদান করেননি। এই কারণে কর্ণকে ১৬ দিনের জন্য মর্ত্যে গিয়ে পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করার অনুমতি দেওয়া হয়। এই পক্ষই পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত হয়। এই কাহিনির পাঠান্তরে, ইন্দ্রের বদলে যমকে দেখা যায়।
তর্পণ অনেক প্রকার, মনুষ্য তর্পণ, ঋষি তর্পণ, দিব্য পিতৃতর্পণ, যম তর্পণ, ভীষ্ম তর্পণ, বাম তর্পণ, শূদ্র তর্পণ প্রভৃতি। ‘ময়া দত্তেন তোয়েন তৃপ্যান্ত ভুবনত্রয়ম’, অর্থাৎ স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল-- তিন ভুবনকেই মন্ত্রের মাধ্যমে স্মরণ করা হয় তিন গণ্ডুষ জল অঞ্জলি দিয়ে৷ হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, যে ব্যক্তি তর্পণ করতে চান, তাঁকে তাঁর পিতার মৃত্যুর তিথিতেই তর্পণ করতে হয়। পুরাণবিদরা বলেন, মহালয়ায় যদি তর্পণ সম্ভব না হয় কার্তিক মাসের অমাবস্যা বা দীপান্বিতা অমাবস্যা পর্যন্ত যে কোনও দিন তর্পণ করা যায়৷ সম্ভব হলে শ্রাদ্ধও করা যেতে পারে৷ হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, জীবিত ব্যক্তির পূর্বের তিন পুরুষ পিতৃলোকে বাস করেন। এই লোক স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত। পিতৃলোকের শাসক যম। তিনিই সদ্যমৃত ব্যক্তির আত্মাকে মর্ত্য থেকে পিতৃলোকে নিয়ে যান। পরবর্তী প্রজন্মের একজনের মৃত্যু হলে পূর্ববর্তী প্রজন্মের একজন পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গে গমন করেন এবং পরমাত্মায় বিলীন হন। গরুড় পুরাণ গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘পুত্র বিনা মুক্তি নাই।’ মার্কণ্ডেয় পুরাণ গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘পিতৃগণ শ্রাদ্ধে তুষ্ট হলে স্বাস্থ্য, ধন, জ্ঞান ও দীর্ঘায়ু এবং পরিশেষে উত্তরপুরুষকে স্বর্গ ও মোক্ষ প্রদান করেন।’
- Subscribe: https://www.youtube.com/c/RAJATKANTIBERA
- Blog: http://rajatkb.blogspot.com
- Google Plus: https://plus.google.com/u/0/
- Linkedin: https://www.linkedin.com/in/rajatkanti-bera-275134139/
- Facebook: https://www.facebook.com/rajatkanti.bera
No comments:
Post a Comment