ছেলেবেলার ফেলে আসা আলোর উৎসব...
দীপাবলি, দেওয়ালি, দিওয়ালি, দীপান্বিতা, দীপালিকা, দীপালি, সুখসুপ্তিকা, সুখরাত্রি বা যক্ষরাত্রি। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, উৎসব আলোরই। প্রদীপের আলোয় উজ্জ্বল চরাচর। কালো মেয়ের পায়ের তলায় আলোর নাচন। ‘তার রূপ দেখে দেয় বুক পেতে শিব, যার হাতে মরণ-বাঁচন’।
রামায়ণ অনুসারে, ত্রেতা যুগে রাবণকে বধ করে রামচন্দ্র ১৪ বছরের বনবাস শেষে অযোধ্যায় ফিরে আসেন। রামচন্দ্রের ফিরে আসার মুহূর্তকে স্মরণীয় করে রাখতে অযোধ্যা জুড়ে সারি সারি প্রদীপ জ্বালানো হয়। অনেকের মতে, মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডবও ১২ বছরের বনবাস ও এক বছরের অজ্ঞাতবাস শেষে ফিরে এসেছিলেন এই দিনে। সেই উপলক্ষ্যে প্রজারা খুশিতে শব্দবাজিতে আগুন দেয়। প্রদীপ জ্বালায়, পালিত হয় দীপাবলি। অনেকে বলেন, রামায়ণ-মহাভারতের সেই উৎসবকে মনে রেখেই প্রচলিত হয়েছে আলোর উৎসব।
শাস্ত্র মতে, ব্রহ্মার নির্দেশে দেবীপক্ষের আগের কৃষ্ণা প্রতিপদে মর্ত্যে নেমে আসেন পিতৃপুরুষরা৷ অপেক্ষা করেন উত্তরসূরীদের কাছ থেকে জল পাওয়ার৷ এই সময় কিছু অর্পণ করা হলে তা সহজেই তাঁদের কাছে পৌঁছয়৷ গোটা পক্ষকাল ধরে পিতৃপুরুষকে স্মরণ ও মননের মাধ্যমে তর্পণ করা হয়৷ যার চূড়ান্ত প্রকাশ বা মহালগ্ন হল মহালয়া৷ মহালয়ার দিন অমাবস্যায় তাঁদের উদ্দেশে জল দানই হল তর্পণ। জল গ্রহণের জন্য যখন মর্ত্যে নেমে আসেন পিতৃপুরুষরা, তখন তাঁদের পথ দেখাতে জ্বালানো হয় আকাশ প্রদীপ। আলোকমালায় সাজানো হয় বাড়ি, পোড়ানো হয় বাজি। কেউ ঘরের দরজা-জানালায় মোতবাতি বা প্রদীপ জ্বালায়, কেউ কলাগাছের খোল দিয়ে নৌকা বানিয়ে তাতে মোমবাতি বা প্রদীপ জ্বেলে ভাসিয়ে দেন পুকুরে বা নদীর জলে। আবার কেউ লম্বা বাঁশের মাথায় কাগজের ছোট ঘর তৈরি করে তার ভেতরে প্রদীপ জ্বালান। আকাশের বুকে প্রদীপ জ্বালানোকেই বলে আকাশ প্রদীপ।
দীপাবলি আলোর উৎসব। চলে পাঁচদিন ধরে। দীপাবলির আগের দিন চতুর্দশীকে বলা হয় ‘নরক চতুর্দশী’। এই দিনই পাঁচদিনের উৎসবের প্রথম দিন। দ্বাপর যুগে গ্রামবাসীদের সঙ্গে নরকাসুরের যুদ্ধ বাধে। কথিত আছে, এই দিনেই শ্রীকৃষ্ণ এবং তাঁর স্ত্রী সত্যভামা নরকাসুরকে বধ করেছিলেন। নরকাসুরের মৃত্যুতে শান্তি ফিরে আসে। সেই আনন্দ উদযাপন করতেই ঘরে ঘরে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানো হয় এবং সেই থেকে দিওয়ালি উদযাপিত হয় নরক চতুর্দশীতে। চতুর্দশীর পরের অমাবস্যা দীপাবলি উৎসবের দ্বিতীয় দিন। দ্বিতীয় দিনেই পালিত হয় মূল উৎসব। গভীর রাতে শাক্ত ধর্মাবলম্বীরা শক্তির দেবী কালীর পুজো করেন। কোথাও কোথাও এদিনে লক্ষ্মীপুজোও করা হয়। বিশ্বাস, ধন-সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর পুজো করলে তিনি ভক্তের কামনা পূর্ণ করেন। তৃতীয় দিন, কার্তিকা শুদ্ধ। চতুর্থ দিন, ভাইফোঁটা বা ভ্রাতৃ দ্বিতীয়া। দিনটিকে যম দ্বিতীয়াও বলা হয়। পরের দিন তৃতীয়া।
দীপাবলি আলোর উৎসব... |
শিখ, জৈন সহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যেও পালিত হয় দীপাবলি। জৈন ধর্মের প্রবর্তক মহাবীর ৫২৭ অব্দে দীপাবলির দিনেই মোক্ষ বা নির্বাণ লাভ করেন। দীপাবলির দিনে শিখ ধর্মগুরু গুরু হরগোবিন্দ সিং অমৃতসরে ফিরে আসেন। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ দিনটিকে ‘অশোক বিজয়াদশমী’ হিসেবেও গণ্য করে থাকে। তাঁদের বিশ্বাস, এই দিনে সম্রাট অশোক সকলকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নিতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী দয়ানন্দ দেহত্যাগ করেন ১৮৮৩ সালের ৩০ অক্টোবর। সেই থেকে আর্য সমাজে দীপাবলি উদযাপিত হয় ‘স্বামী দয়ানন্দ প্রভুর মৃত্যুবার্ষিকী’ হিসেবে।
কিন্তু তেল? যেখানে বাজি কেনার তহবিলে টান, সেখানে প্রদীপ জ্বলবে কীসে? ব্যবস্থা ছিল তারও। প্রাইমারি স্কুলে একটি ছেলে আমাদের সঙ্গে পড়ত। নাম মনে আছে, সত্য বাগ। আমাদের থেকে বয়সে বেশ বড়। ফলে, চার ক্লাস পাস দেওয়ার আগেই সে কাজে লেগে পড়ল। সুলতাননগর বাসস্ট্যান্ডের সামনে বিদ্যুতের সাবস্টেশনের ভেতরে চায়ের দোকান দিল সত্য। সেই সঙ্গে ব্যবস্থা করে ফেলল উপরি ইনকামের। সাবস্টেশন চত্বরে পড়ে থাকা বাতিল ট্রান্সফর্মারের পোড়া তেল বিক্রি। ৫ টাকায় ৫ লিটার। হাতে যেন চাঁদ পেলাম! দীপাবলির দিন সকাল সকাল কিনে আনতাম সেই তেল। তারপর শুরু হত সলতে পাকানো। দুপুরে খাওয়ার পর প্রদীপ সাজানো। তখন আমাদের টালির চালের মাটির দেড়তলা বাড়ি। তখন আমি ১০ কি ১১। ওই বয়সেই বাঁশের তৈরি বড় মই নিয়ে টালির চালের কোণা বরাবর, চালের ধারে ধারে, দরজা-জানালার দু’পাশে, তুলসি তলায় প্রথমে কাদামাটির ছোট ছোট মণ্ড বসাতাম। তারপর তার ওপর সোজা করে চেপে বসাতে হত প্রদীপ। বসানোর পর প্রতিটি প্রদীপে সলতে দেওয়া। আলো যাতে দাউ দাউ করে জ্বলে না ওঠে, সেজন্য প্রদীপের মুখে সলতের ওপর কাদামাটি দিয়ে ঘিরে দেওয়া। সব শেষে তেল দেওয়া হত সব প্রদীপে। দুপুর-বিকেল গড়িয়ে তখন প্রায় সন্ধে। অফিস থেকে বাবার ফেরার সময় হয়ে গিয়েছে। বাবা এসব দেখলে নির্ঘাত পিঠে পড়বে!
কে লইবে মোর কার্য, কহে সন্ধ্যারবি।
শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি।
মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল, স্বামী,
আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সামনেই দীপাবলি।
উৎসবের নাম দীপাবলি হলেও বিদ্যুতিন টুনি-বাল্বের এই সময়ে হারিয়ে যেতে বসেছে মাটির প্রদীপ। জগতের অন্ধকার দূর করার মতো গুরুদায়িত্ব পালনে অস্তগামী সূর্যের আহ্বানেসাড়া দিতে যে পিছ পা হয়নি, প্রতিযোগিতার বাজারে তার যে টিকে থাকার সাধ্য নেই! আজ সে নিজেই অস্তগামী! কদর কমেছে মোমবাতিরও। কালীপুজোর সময় বাজারে যে মাটির প্রদীপ দেখা যায়, তা সলতে ও মোম দিয়ে একদম রেডি টু ইউজ। আলো জ্বালানোর জন্য সলতে পাকানোর সেই সময় যেমন নেই, বোধহয় ইচ্ছেটাও নেই। ফলে, সেই স্বাদটাও নেই। মনে আছে, ছোটবেলায় কালীপুজোর মাসখানেক আগে থেকে শুরু হত আমাদের প্রস্তুতি। ১৯৮৩-৮৪ সালের কথা। বাজি কেনার জন্য তখন বাবার কাছ থেকে বরাদ্দ ছিল ৫০ টাকার মতো। কিন্তু তাতে আর কী হয়! তখন কোনও বাজি নিষিদ্ধ হয়নি। চকলেট বোমা, দোদমা, আলুবোম, বাক্সবোম - কত কী। আরও অন্তত ১০০ টাকার ব্যাপার। সেই ১০০ টাকা জোগাড় করার জন্য কী না করতাম! কাগজের ঠোঙা তৈরি থেকে, বাড়িতে জমে থাকা ভাঙা কাচ, বাতিল লোহার জিনিসপত্র জমা করে বিক্রি। তহবিল সংগ্রহের পাশাপাশি, চলত মাটির প্রদীপ তৈরি। যাতে মোমবাতি কেনার খরচ বাঁচে। পুকুরের পাড় থেকে কালো এঁটেল মাটি তুলে এনে ভাইয়েরা মিলে তৈরি করতাম প্রদীপ, রোদে ভালো করে শুকিয়ে, মায়ের রান্না হয়ে যাওয়ার পর কাঠের উনুনের গনগনে আগুনে ফেলে দিতাম। বিকেলে উনুন ঠান্ডা হলে বের হত ঝকঝকে পোড়া মাটির প্রদীপ।
শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি।
মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল, স্বামী,
আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সামনেই দীপাবলি।
উৎসবের নাম দীপাবলি হলেও বিদ্যুতিন টুনি-বাল্বের এই সময়ে হারিয়ে যেতে বসেছে মাটির প্রদীপ। জগতের অন্ধকার দূর করার মতো গুরুদায়িত্ব পালনে অস্তগামী সূর্যের আহ্বানেসাড়া দিতে যে পিছ পা হয়নি, প্রতিযোগিতার বাজারে তার যে টিকে থাকার সাধ্য নেই! আজ সে নিজেই অস্তগামী! কদর কমেছে মোমবাতিরও। কালীপুজোর সময় বাজারে যে মাটির প্রদীপ দেখা যায়, তা সলতে ও মোম দিয়ে একদম রেডি টু ইউজ। আলো জ্বালানোর জন্য সলতে পাকানোর সেই সময় যেমন নেই, বোধহয় ইচ্ছেটাও নেই। ফলে, সেই স্বাদটাও নেই। মনে আছে, ছোটবেলায় কালীপুজোর মাসখানেক আগে থেকে শুরু হত আমাদের প্রস্তুতি। ১৯৮৩-৮৪ সালের কথা। বাজি কেনার জন্য তখন বাবার কাছ থেকে বরাদ্দ ছিল ৫০ টাকার মতো। কিন্তু তাতে আর কী হয়! তখন কোনও বাজি নিষিদ্ধ হয়নি। চকলেট বোমা, দোদমা, আলুবোম, বাক্সবোম - কত কী। আরও অন্তত ১০০ টাকার ব্যাপার। সেই ১০০ টাকা জোগাড় করার জন্য কী না করতাম! কাগজের ঠোঙা তৈরি থেকে, বাড়িতে জমে থাকা ভাঙা কাচ, বাতিল লোহার জিনিসপত্র জমা করে বিক্রি। তহবিল সংগ্রহের পাশাপাশি, চলত মাটির প্রদীপ তৈরি। যাতে মোমবাতি কেনার খরচ বাঁচে। পুকুরের পাড় থেকে কালো এঁটেল মাটি তুলে এনে ভাইয়েরা মিলে তৈরি করতাম প্রদীপ, রোদে ভালো করে শুকিয়ে, মায়ের রান্না হয়ে যাওয়ার পর কাঠের উনুনের গনগনে আগুনে ফেলে দিতাম। বিকেলে উনুন ঠান্ডা হলে বের হত ঝকঝকে পোড়া মাটির প্রদীপ।
উনুন ঠান্ডা হলে বের হত ঝকঝকে পোড়া মাটির প্রদীপ... |
সন্ধে হলে পোড়া তেলে জ্বলে উঠত পোড়া মাটির প্রদীপ। বাড়ির চার পাশ হয়ে উঠত অদ্ভূত আলোকোজ্জ্বল। তখনও আমাদের বাড়িতে স্থায়ীভাবে বিদ্যুৎ আসেনি। অস্থায়ী ব্যবস্থায় জ্বালানো হত আলো। দীপাবলির সন্ধ্যায় অবশ্য বাইরে বিদ্যুতের আলো জ্বালা হত না। হেমন্তের সন্ধ্যায় প্রদীপের সেই আলোয় এক মোহময় পরিবেশের তৈরি হত। দেখতাম, হাওয়ার দাপটে কোনও প্রদীপ নিভে গেলে বাবা দেখিয়ে দিতেন বা নিজের হাতে ফের জ্বেলে দিতেন। বাবারও ভাল লাগছে বুঝতে পেরে মনটা ভরে উঠত।
পোড়া তেলের জন্য একটু ধোঁয়া হত ঠিকই, কিন্তু ছোট হাতে তৈরি সেই আলো আজ বড় মিস করি। আজকে আমিই দুই সন্তানের বাবা। শহরের ফ্ল্যাটে থাকি। ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ফ্ল্যাটের ছাদে, জানালা, বারান্দায় টুনি বাল্ব টাঙাতে টাঙাতে মনে হয়, ফেলে আসা সেই সব দিনের কথা। সেই আলোর উৎসবের কথা।
- Subscribe: https://www.youtube.com/c/RAJATKANTIBERA
- Blog: http://rajatkb.blogspot.com
- Google Plus: https://plus.google.com/u/0/
- Linkedin: https://www.linkedin.com/in/rajatkanti-bera-275134139/
- Facebook: https://www.facebook.com/rajatkanti.bera
No comments:
Post a Comment