‘শিবালিক’-এ সূর্যোদয়!
কালকা মেলের টিকিট আগে কেটে রাখলেও কালকা থেকে সিমলা যাওয়ার শিবালিক ডিলাক্স এক্সপ্রেসের টিকিট কাটতে দেরি হয়েছিল। ফলে, ২টো কনফার্মড-এর পাশাপাশি ২টো ওয়েটিং ছিল। ওয়েটিং লিস্ট ১ ও ২।
শিবালিক এক্সপ্রেস হচ্ছে কালকা মেলের কানেক্টিং ট্রেন। কালকা মেল কালকা পৌঁছয় ভোর সাড়ে চারটেয়। শিবালিক কালকা ছাড়ে সকাল ৫টা ২০-তে। আপ কালকা মেল দেরি করে পৌঁছলে দেরি করে ছাড়ে শিবালিক। উল্টো দিকে, শিবালিক সিমলা থেকে দেরি করে কালকা পৌঁছলে অপেক্ষা করে ডাউন কালকা মেল। কিন্তু কতটা দেরি? ইন্টারনেট ঘেঁটে নম্বর জোগাড় করে একদিন ফোন করে বসলাম কালকার স্টেশন ম্যানেজারকে। বললেন, কালকা মেল ১ থেকে ২ ঘণ্টা দেরি করলে অপেক্ষা করে শিবালিক। তার বেশি নয়।
সোঘি স্টেশনে দাঁড়িয়ে শিবালিক এক্সপ্রেস। ছবি - লেখকের তোলা |
কিন্তু মাথা ব্যথা বাড়াল কালকা মেল। আগের লেখায় বলেছি, সন্ধে ৭টা ৪০-এর জায়গায় ট্রেন ছাড়ে রাত ২টো ২০-তে। কালকা পৌঁছয় ১৭ ঘণ্টা ৫ মিনিট লেট-এ। তৃতীয় দিন রাত ৯টা ৩৫-এ। এমনটা হবে বুঝতে পেরে ট্রেনে বসেই শিবালিকের টিকিট ক্যানসেল করে পরের দিন ভোরের টিকিট কেটে রেখেছিলাম। মাথাপিছু ৪২০ টাকা। কিন্তু রাতটা কাটবে কোথায়? অগত্যা কালকা স্টেশনের রেলওয়ে ক্যান্টিনে খেয়ে ওয়েটিং রুমে রাত্রিবাস!
কালকা ও সিমলার মাঝে ১৬টি স্টেশন। টাকশাল, গুম্মান, কোটি, সোনওয়ারা, ধরমপুর, কুমারহাটি, ব্যারগ, সোলান, সালোকরা, কান্দাঘাট, কানোহ, কাঠলিঘাট, সোঘি, তারাদেবী, জুটোঘ ও সামারহিল। কিন্তু ৯৬ কিলোমিটার যাত্রাপথে একটিমাত্র স্টেশনেই থামে শিবালিক। ব্যারগ-এ। কালকা থেকে ৪৩ কিলোমিটার দূরের ওই স্টেশন থেকেই যাত্রীদের জন্য সকালের খাবার তোলা হয়। কালকা থেকে সিমলা যাওয়ার পথে কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট দেওয়া হয় যাত্রীদের। সিমলা থেকে কালকা ফেরার পথে ডিনার। ট্রেন ছাড়ার একটু পরে অ্যাটেন্ডেন্ট এসে জেনে গেলেন, আমরা ভেজ না নন ভেজ।
সকাল ৭টা ২৫। শিবালিক-এ সূর্যোদয়! অসাধারণ অভিজ্ঞতা! হাল্কা সোনালি রোদে সোনা হয়ে উঠেছে পাহাড় চূড়া। জানালা দিয়ে মিঠে রোদ এসে পড়েছে আমাদের কামরায়। মনের কোণে গুনগুনিয়ে উঠল সেই সুর..... ‘সোনা ঝরছে, ঝরে পড়ছে, কী মিষ্টি এ সকাল...!’
জানালা দিয়ে ভালই রোদ এসে পড়েছে কামরায়। ছুটছে শিবালিক। খেতে খেতে পাহাড়ে উঠছি আমরা। প্রথম দিকে দু’ধারে কিছু ছোট ছোট পাহাড়ি বাড়ি ঘর চোখে পড়ছিল। কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পর সেগুলো উধাও। কখনও একপাশে উঁচু পাহাড় আর অন্য পাশে গভীর খাদ। আবার কখনও ছোট ছোট ঝরনা। হিমালয়ের প্যানোরামিক ভিউ...।
ভোর ৫টা। স্টেশনে দাঁড়িয়ে শিবালিক।
আমাদের টিকিট সি-২ কামরায়। ইঞ্জিনের পর সি-১, তারপর সি-২। টিকিট কাটার সময় থেকেই সিট নম্বর থাকে। কিন্তু ট্রেন ছাড়ার আগে অ্যাটেন্ডেন্ট-এর সঙ্গে কথা বলে সিট পছন্দ বা নিজের ইচ্ছে মতো দিকে ঘুরিয়ে নেওয়া যায়। শতাব্দী শ্রেণির শিবালিক চেয়ার কার। মিটার গেজ লাইন। ছোট কামরা। দু’পাশে দু’টি করে গদি মোড়া চেয়ার। কার্পেট মোড়া মেঝে। বাইরের দৃশ্য দেখার জন্য বিশাল বিশাল কাচের জানালা। জানালায় সুদৃশ্য পর্দা।
ছাড়ার কথা, ৫টা ২০-তে। শিবালিক ছাড়ল ৫ মিনিট দেরিতে। বাইরে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিচ্ছু দেখা যায় না। অন্ধকারেই পাহাড়ের বাঁক ঘুরে ঘুরে সাপের মতো বেঁকে বেঁকে ওপরে উঠতে শুরু করল হেরিটেজ ট্রেন। আমাদের সিট ছিল ডান দিকে, জানালার ধারে। যখনই বাঁক ঘুরছিল শিবালিক, তখনই সামনের কামরা থেকে পিছনের কামরাগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। অদ্ভুত লাগছিল অন্ধকারের মধ্যে আলো জ্বলা কামরাগুলিকে! একটা কথা, শিবালিকে চড়লে, ডান দিকের সিটে বসার চেষ্টা করবেন। কারণ, পুরো যাত্রাপথে জানালার ডান দিকেই সরে সরে যাবে চোখ জুড়োন পাহাড়।
খাবার তোলার জন্য ব্যারগ স্টেশনে দাঁড়িয়ে শিবালিক এক্সপ্রেসে। ছবি - লেখকের তোলা |
ক্রমেই পাহাড়ে উঠছে শিবালিক। ওই দিনের কালকা মেল তখনও না আসায় যাত্রী সংখ্যা কম। বেশ কয়েকটা আসন খালি। যাঁর যেখানে পছন্দ সেখানে গিয়ে বসছেন। মজা করছেন। কিন্তু সূর্য না ওঠায় তখনও বাইরেটা ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। বোঝা যাচ্ছে, একটার পর একটা সুড়ঙ্গ পেরিয়ে চলেছে টয় ট্রেন। দার্জিলিঙের টয় ট্রেনে এখনও চড়া হয়নি। সিমলা যাওয়ার পথে আবছা আলোয় বেশ টের পাচ্ছিলাম খেলনা ট্রেনের মজা!
সকাল ৭টা ২৫। শিবালিক-এ সূর্যোদয়! অসাধারণ অভিজ্ঞতা! হাল্কা সোনালি রোদে সোনা হয়ে উঠেছে পাহাড় চূড়া। জানালা দিয়ে মিঠে রোদ এসে পড়েছে আমাদের কামরায়। মনের কোণে গুনগুনিয়ে উঠল সেই সুর..... ‘সোনা ঝরছে, ঝরে পড়ছে, কী মিষ্টি এ সকাল...!’
কালকা থেকে সিমলা যাওয়ার পথে অনেকগুলো সুড়ঙ্গ পেরোতে হয়। সুড়ঙ্গগুলির মধ্যে সব থেকে লম্বা ৩৩ নম্বর ব্যারগ সুড়ঙ্গ। ১১৪৩.৬১ মিটার লম্বা। ঘণ্টায় ২৫ কিলোমিটার বেগে দৌড়লে ব্যারগ সুড়ঙ্গ পেরোতে টয় ট্রেনের সময় লাগে ২ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড। শিবালিকেরও প্রায় তাই লাগল। ব্যারগ সুড়ঙ্গ পার হলেই ব্যারগ স্টেশন। আমরা ব্যারগে পৌঁছলাম সকাল ৭টা ৩8-এ। ট্রেন থামতেই যাত্রীরা সবাই যে যার মতো নেমে পড়লেন। ঘুরে দেখতে লাগলেন চারপাশ। রেলের কর্মীরা তুললেন খাবারদাবার, জল। প্রায় আধ ঘণ্টা ব্যারগ স্টেশনে দাঁড়াল শিবালিক। তারপর আবার শুরু হল যাত্রা।
এতক্ষণ কিছু মনে হয়নি, ট্রেনে খাবার তোলা হতেই খিদেটা যেন চাগাড় দিয়ে উঠল। রাতের রেল ক্যান্টিনের ডাল-ভাতে আর কতক্ষণ চলে! কিছুক্ষণ পরই অ্যাটেন্ডেন্ট এসে সবার সামনে ছোট ছোট ফোল্ডিং টেবিল পেতে দিয়ে গেলেন। তারপর ছোট ছোট ট্রে-তে করে এল ২ পিস ব্রাউন ব্রেড, ওমলেট, মটর-গাজর সেদ্ধর সঙ্গে আলু ভাজা, ছোট প্যাকেটে বাটার, টম্যাটো সস। খাওয়ার পর বড়দের জন্য চা। ছোটদের পাশাপাশি, চা না নিলে বড়দের জন্যও ফ্রুট জুস।
জানালা দিয়ে ভালই রোদ এসে পড়েছে কামরায়। ছুটছে শিবালিক। খেতে খেতে পাহাড়ে উঠছি আমরা। প্রথম দিকে দু’ধারে কিছু ছোট ছোট পাহাড়ি বাড়ি ঘর চোখে পড়ছিল। কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পর সেগুলো উধাও। কখনও একপাশে উঁচু পাহাড় আর অন্য পাশে গভীর খাদ। আবার কখনও ছোট ছোট ঝরনা। হিমালয়ের প্যানোরামিক ভিউ...।
বাইরে ঝলমলে রোদ। পরিস্কার আকাশ। জানালায় সরে সরে যাচ্ছে রোদে ভেজা পাহাড়, খাদ, জঙ্গল, ঝরনা, ঘরবাড়ি। একের পর এক স্টেশন পেরিয়ে যাচ্ছে শিবালিক। দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে সময়। ট্রেনের থেকেও যেন জোরে ছুটছে ঘড়ির কাঁটা।
সকাল ১০টা ৪৩। ধীর হয়ে এল ট্রেনের গতি। বাইরে তাকিয়ে দেখি, ‘সিমলা’ লেখা একটা বোর্ড জানালার পাশ দিয়ে সরে সরে যাচ্ছে। সিমলা এসে গেল! আমাদের যাত্রা শেষ! অদ্ভূত এক অভিজ্ঞতার সাক্ষী হওয়ার আনন্দ সবার চোখে মুখে।
সঙ্গে মন খারাপও, এবার নামতে হবে তো!
কীভাবে যাবেন - সিমলা যাওয়ার অনেক রাস্তা। কলকাতা থেকে ট্রেনে কালকা হয়ে। কলকাতা থেকে দিল্লি বা চণ্ডীগড় হয়েও যাওয়া যায়।
কোথায় থাকবেন - সিমলায় অসংখ্য হোটেল। নিজের মতো বেছে নিলেই হল। অনলাইনে সার্চ করতে পারেন।
কখন যাবেন -
মার্চ থেকে জুন - এই সময় আবহাওয়া সুন্দর থাকে। অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের জন্য আদর্শ। তবে বরফ পাবেন না।
জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর - বর্ষাকাল। সবুজ সিমলা উপভোগ করতে চাইলে আদর্শ সময়। কিন্তু ধসের ভয় থাকে।
অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি - বরফ পড়া দেখতে চাইলে উপযুক্ত সময়। কিন্তু হাড় কাঁপানো ঠান্ডা!
- Subscribe: https://www.youtube.com/c/RAJATKANTIBERA
- Blog: http://rajatkb.blogspot.com
- Google Plus: https://plus.google.com/u/0/
- Linkedin: https://www.linkedin.com/in/rajatkanti-bera-275134139/
- Facebook: https://www.facebook.com/rajatkanti.bera
No comments:
Post a Comment