সিমলার ডায়েরি (দ্বিতীয় দিন):
অভয়ারণ্যে কৃষ্ণসার... কুফরির ঘোড়া... বিশ্বের দীর্ঘতম হনুমান মূর্তি!
(এই সাইটে আগের লেখা, ‘সিমলার ডায়েরি (প্রথম দিন): মল রোড, দ্য রিজ, লোয়ার বাজার, গর্টন ক্যাসেল, স্টেট মিউজিয়াম’-এ লিখেছি, প্রথম দিন আমরা হেঁটে দেখেছি সিমলা শহরের নানা জায়গা। আজকের লেখায় দ্বিতীয় দিনের কথা...)
আগের দিন সন্ধ্যাতেই গাড়ি বুক করা ছিল। ১১০০ টাকায় সারাদিন সাইট সিইং...। সকাল ৯টা বাজতে না বাজতে হোটেলে গাড়ি হাজির।
হিপ হিপ হুররে...
আসল নাম, নাগসন্স অ্যামিউজমেন্ট অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার পার্ক। সবাই চেনে, হিপ হিপ হুররে নামে। মল রোড থেকে ১৭ কিমি। একদিকে গভীর খাদ, অন্যদিকে খাড়া পাহাড়। পাহাড়ি এলাকার রাস্তার চরিত্রই এই। গাড়িতে লাগল ৪৫ মিনিট। পৌঁছলাম সকাল ১০টা নাগাদ। দূষণহীন ৫ হাজার বর্গমিটার সবুজ এলাকা জুড়ে বিনোদন পার্ক। ভার্চুয়াল গেম থেকে রোমাঞ্চকর নানা রকম খেলা ও বিনোদনের ব্যবস্থা। জিপ লাইনিং, ভ্যালি ক্রশিং, নেট ক্লাইম্বিং, ওয়াটার জর্বিং, মুভিং টানেল প্রভৃতি। আছে বেশ কিছু ইন্ডোর গেমও। কেনাকাটার দোকান, পেটপুজোর রেস্তোরাঁ। কিন্তু ঢোকার টিকিট ১০০টাকা। গেম এবং রাইডের প্যাকেজ মাথা পিছু ৭০০টাকা! কেনাকাটা বা খাওয়ার খরচ আলাদা। খরচটা বেশি, সন্দেহ নেই। কিন্তু আনন্দ অফুরান। পার্ক সপ্তাহে ৭ দিনই খোলা। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সন্ধে ৬টা।
কুফরি...
হিমাচল প্রেদেশের ছোট্ট পাহাড়ি জায়গা কুফরি। সমুদ্রতল থেকে উচ্চতা ৭ হাজার ৫১০ ফুট। হিপ হিপ হুররে... থেকে কুফরি ১৩ কিমি। গাড়িতে সময় লাগে ৩৫ মিনিটের মতে। বিপদসঙ্কুল অসাধারণ সুন্দর পাহাড়ি রাস্তা! ভয়ে বুক শুকিয়ে যায়, আবার চারপাশ দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়!
ঘোড়-সওয়ারদের স্বর্গরাজ্য সিমলা। রুক্ষ পথ বেয়ে ঘোড়ার পিঠে পাহাড়ে চড়ার মজাই আলাদা। বেলা পৌনে ১২টা নাগাদ আমরা পৌঁছলাম হর্স পয়েন্টে। এখান থেকেই কুফরিতে যেতে হবে ঘোড়ার পিঠে। তাই এরকম নাম। গাড়ি থেকে নামতেই ছেঁকে ধরলেন অনেকে। সবার ঘোড়াই পাহাড়ে ওঠার জন্য তৈরি। মাথাপিছু ৫০০ টাকা। দু’-চারজনের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল ফিক্সড রেট। আমরা চার জন। কড়কড়ে একটা ২০০০ টাকার নোট বের করে দিতে মন সায় দিল না। অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে তিনটে ঘোড়ায় রাজি করানো গেল। খুদে দু’জনের জন্য ব্যবস্থা হল একটি ঘোড়ায়। টাকা পেয়েই হাতে হাতে বিল বানিয়ে দিলেন ঘোড়ার মালিক। বিলে লিখে দিলেন একটা ফোন নম্বর। ফোন নম্বর কেন? আসলে, যে ঘোড়া যে সওয়ারি নিয়ে যাবে, সেই ঘোড়া সেই যাত্রীকে নিয়ে ফিরবে না। ফেরার সময় সেখানে যে সব ঘোড়া থাকবে তাদেরই কেউ নিয়ে আসবে সওয়ারিদের। কুফরিতে ঘোরা শেষ হলে ওই নম্বরে ফোন করতে হবে। তাহলেই হাজির হয়ে যাবে ফিরতি ঘোড়া।
বেলা ১২টা নাগাদ রওনা হলাম ঘোড়ার পিঠে। খাড়াই পথে ঘোড়ার গতি কম, কিন্তু রুক্ষ পাথর আর ঘোড়ার পায়ের নালের ঠোকাঠুকিতে টগবগ টগবগ আওয়াজটা বেশ কানে আসছিল। ঘোড়ার লাগাম আমাদের হাতে নেই। তবে ধরে বসার অন্য ব্যবস্থা আছে। এক লাগামের সঙ্গে অন্য লাগাম বেঁধে দিয়ে এক প্রান্ত ধরে আছেন সহিস। যাতে কোনওভাবেই কোনও ঘোড়া দলছুট হতে না পারে। আমরা ঘোড়ার পিঠে, আর সহিস যুবক লাগাম ধরে হাঁটছেন পাশে পাশে। তখনও সিমলায় বরফ পড়েনি। কেন পড়েনি? জিজ্ঞেস করতেই যুবক বললেন, তিনিও বুঝতে পারছেন না, কেন এবার এমন হল!
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম কুফরি-তে। ‘কুফরি’ শব্দটি এসেছে স্থানীয় শব্দ ‘কুফ্র’ থেকে। ‘কুফ্র’ নামে ‘লেক’। জায়গাটা দেখতে লেকের মতোই। চারপাশে পাহাড়, মাঝে ঢালু জায়গা। প্রতি বছর জানুয়ারিতে এখানে ‘স্নো স্ট্যাচু কম্পিটিশন’ হয়। ফেব্রুয়ারিতে হিমাচল ট্যুরিজম এর উদ্যোগে হয় উইন্টার স্পোর্টস ফেস্টিভ্যাল। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, শীতের সময় বরফ পড়লে সিমলার মধ্যে সব থেকে দেখতে সুন্দর হয় কুফরি। বরফ না থাকলেও একেবারে অন্যরকম কুফরি...। শান্ত... স্নিগ্ধ... নির্জন। মাথার ওপর নীল আকাশ যেন দূরের বরফ সাদা পাহাড়ের মাথায় গিয়ে নেমেছে। পাহাড়ের মাথায় মন্দির। পতপত করে উড়ছে পতাকা।
জায়গায় জায়গায় পাহাড়ি খরগোস নিয়ে দাঁড়িয়ে মহিলারা। অসংখ্য চমরি গাই। আসলে, খরগোস হাতে নিয়ে বা গাইয়ের পিঠে উঠে ছবি তোলার ব্যবস্থা। তবে তার জন্য দক্ষিণা লাগবে। দরদাম করে উঠবেন, না হলে নামার পর ঝামেলার শেষ থাকবে না। আছে দূরবীণ দিয়ে দূর-দর্শণের ব্যবস্থা। তার জন্যও ফেলতে হবে কড়ি। মাথাপিছু ১৫০ টাকা। আছে কেনাকাটার অসংখ্য দোকান, খাবারের পসরা।
ফাগু...
কুফরি থেকে ৬ কিমি দূরে ফাগু। সমুদ্রতল থেকে উচ্চতা প্রায় ২৫০০ মিটার। কুফরির মতো ফাগুও শীতে স্কি আর উইন্টার স্পোর্টস-এর জন্য বিখ্যাত। পর্যটকদের প্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট। ফাগু থেকে দেখা প্রাকৃতিক দৃশ্য চোখে লেগে থাকবে। তবে একটা বিষয়ে সচেতন থাকবেন, বেশিরভাগ গাড়ির চালকই কুফরি ঘুরিয়ে বলে, যাহাই কুফরি, তাহাই ফাগু। আদতে তা নয়। দু’টো একেবারে আলাদা জায়গা। আমাদের জানা ছিল না বলে সমস্যায় পড়তে হয়েছিল।
কুফরি জু...
ফাগু থেকে ফিরে যখন অভয়ারণ্যে ঢুকলাম, ঘড়িতে তখন আড়াইটে। প্রাকৃতিক পরিবেশে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, বাদামি ভালুক, তুষার চিতা, কৃষ্ণসার হরিণ, ভারতীয় লাল শেয়াল ও ডোরা কাটা হায়নার দল। আছে হিমাচল প্রদেশের জাতীয় পাখি মোনাল। প্রায় সাড়ে দশ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই অভয়ারণ্যে ভর্তি সরলবর্গীয় গাছ, রয়েছে পাহাড়ি ঝরনা, গভীর খাদ। অভয়ারণ্যে ঢুকলে দল বেঁধে ঢুকবেন, না হলে, পশুদের অভয়ারণ্যে ভয়ে গা ছমছম করবে মানুষের।
ইন্দিরা ট্যুরিস্ট পার্ক...
কুফরি অভয়ারণ্যের গেট দিয়ে বেরিয়ে গাড়িতে উঠবেন না। ডান দিকে পিচের ঢালু রাস্তা ধরে হেঁটে এগিয়ে চলুন ওপরের দিকে। সামনেই পড়বে ইন্দিরা ট্যুরিস্ট পার্ক। ১৯৭২ সালে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সিমলা চুক্তি স্বাক্ষরের সময় এই এলাকায় এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী। তাঁর নামেই পার্কের নাম। সপ্তাহে ৭দিনই খোলা। বড়দের টিকিট ১০ টাকা, ছোটদের ৫ টাকা। আছে নানা রাইডের ব্যবস্থা, ভিডিও গেম, আইসক্রিম পার্লার, কাফে। গলা ভেজাতে চাইলে আছে বিয়ার বার। বাইরে রাস্তার ধারে প্রচুর হাতের কাজের জিনিসের দোকান।
গ্রিন ভ্যালি...
ইন্দিরা ট্যুরিস্ট পার্কে কেনাকাটা সেরে গাড়িতে উঠলাম। আমাদের এবারের গন্তব্য গ্রিন ভ্যালি। সত্যিই সবুজ উপত্যকা। ঠিক যেন পিকচার পোস্টকার্ড। দেবদারু আর পাইনের ঘন জঙ্গল ঘেরা পাহাড়ের সারি। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। ছবি তোলার জন্য মন ছটফট করে।
জাখু মন্দির...
সিমলার বিখ্যাত কালী মন্দিরের ওপর থেকে যখন জাখুর হনুমান মূর্তি দেখেছিলাম, তখনই জায়গাটায় যাওয়ার ইচ্ছে চেপেছিল মাথার মধ্যে। কারণ, জাখু পাহাড়ের মাথায় বিশ্বের সব থেকে লম্বা হনুমান মূর্তি। সমুদ্রতল থেকে ২২৯৬ ফুট উচ্চতায় ব্রাজিলের রিও ডি জেনেইরোর ক্রাইস্ট দ্য রিডিমারের উচ্চতা ৯৮ ফুট। জাখু পাহাড় সিমলার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। সমুদ্রতল থেকে উচ্চতা ৮১০০ ফুট। আর হনুমান মূর্তির উচ্চতা ১০৮ ফুট।
জাখু পাহাড়ের ওপর থেকে দেখা যায় গোটা সিমলা শহর, শিবালিক পর্বতমালা। জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে হনুমানের বিশাল মূর্তি। কিংবদন্তী আছে, বিশল্যকরণীর খোঁজে গোটা পাহাড় তুলে আনার সময় প্রভু হনুমান এখানে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। তাই জাখু হনুমান ভক্ত এবং পর্যটকদের মধ্যে খুবই প্রিয়। ২০১০ সালে মূর্তিটি তৈরি হয় দেড় কোটি টাকা খরচ করে। ওই বছরেরই ৫ নভেম্বর মূর্তিটির উদ্বোধন করেন অভিনেতা অভিষেক বচ্চন।
মল রোড থেকে কিলোমিটার দেড়েক দূরে জাখু পাহা়ড়। অন্য রাস্তার তুলনায় এই রাস্তাটা খারাপ, এবড়োখেবড়ো। তবে মন্দিরের সিঁড়ি পর্যন্ত গাড়ি পৌঁছে যায়। গাড়ি দরজা খুলে নামতেই পিছন থেকে কে যেন কাঁধের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুনতে পেলাম, পাশ থেকে একজন চিত্কার করে বলছেন, ‘দাদা, আপকা চশমা গয়া...!’ কয়েক মুহূর্তের জন্য মাথাটা যেন ব্ল্যাঙ্ক! সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখলাম, দূরে বসে থাকা একটি বানরের হাতে আমার দামি চশমা! সর্বনাশ! পাশ থেকে এক ব্যক্তি বললেন, ফল দিন, চশমা পেয়ে যাবেন। আমাদের ব্যাগে ফল ছিল, সেই ফল নিয়ে কাছে গিয়ে হাতে দিতেই চশমা ফেলে পালাল বানর। হাতে চশমা এল, ধড়ে যেন প্রাণ এল!
সামনে বেশ কয়েকটা খাড়াই সিঁড়ি। সিঁড়ির মুখে এক ব্যক্তি বসে, সঙ্গে একগাদা লাঠি। বুঝতে পারলাম লাঠির প্রয়োজনীয়তা। লাঠি দিয়ে হনুমান আর বানর তাড়াতে তাড়াতে বেশ কিছুটা ওঠার পর পাহাড়ের মাথায় বিশাল সমতল জায়গা। একদিকে, মন্দির অন্যদিকে বিশাল হনুমান মূর্তি। একটু নীচে ছোটদের খেলার পার্ক। অসাধারণ পরিবেশ। কিন্তু ততক্ষণে সূর্য পশ্চিমে ঢলতে শুরু করেছে। আধ ঘণ্টার বেশি ঘোরা হল না। গাড়িতে করে নামতে নামতে মনে হল, ইশ, আরও আগে এল ভাল হত!
কীভাবে যাবেন -
কীভাবে কখন যাবেন, এই ব্লগে আগের লেখা (‘শিবালিক’-এ সূর্যোদয়)-এ বলেছি।
কোথায় থাকবেন -
সিমলায় সব থেকে ভাল থাকার জায়গা হল মল রোড। কারণ, এখান থেকে যে কোনও জায়গায় যাওয়া সুবিধাজনক। তাই, মল রোডে গিয়ে নিজের পছন্দ মতো একটা হোটেল খুঁজে নিয়ে উঠে পড়ুন। ৭৫০ টাকা থেকে হোটেলের ঘরভাড়া শুরু। পিক সিজন হলে ভাড়া একটু বেশি হতে পারে। মোটামুটি ১০০০ টাকা বাজেট হলে ভাল হোটেলই মিলবে। যাওয়ার আগে একটু ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে নিলে সুবিধা হবে। চাইলে অনলাইন বুকিংও করে নিতে পারেন। যদি পারেন কালীবাড়ি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। এখানকার যাত্রীনিবাসে থাকার জায়গা পেলে থাকা-খাওয়ার খরচ অন্য যে কোনও জায়গার থেকে কম হবে। থাকার জায়গা হিসেবে পছন্দ না হলে, এখানে খেয়ে অন্য জায়গায় থাকতে পারেন।
যোগাযোগ -
2H, 2ND FLOOR, ELECTRONIC CENTRE,
1-1 A, BIPLABI ANUKUL CHANDRA ST. ,KOLKATA - 700072
1-1 A, BIPLABI ANUKUL CHANDRA ST. ,KOLKATA - 700072
Contact No. :033-22126361(P) 0000000000(M) 033-22127470
Email-Id: kolkata@hptdc.in
M/s Himachal Pradesh Helpline Tourism , E-Mall, Shop No.104, First Floor, 6 Chitranjan Avenue, Kolkata-72
Tel: (033) 22124007/6 Toll Free No: 18001808082
E-mail: helpline_tourism@yahoo.co.in
Website: www.himachalhelplinetourism.com
- Subscribe: https://www.youtube.com/c/RAJATKANTIBERA
- Blog: http://rajatkb.blogspot.com
- Google Plus: https://plus.google.com/u/0/
- Linkedin: https://www.linkedin.com/in/rajatkanti-bera-275134139/
- Facebook: https://www.facebook.com/rajatkanti.bera
No comments:
Post a Comment