শরতের শারদোৎসব ‘অকালবোধন’ কেন?
সংস্কৃত ‘অকাল’ শব্দের অর্থ, অসময় বা যে সময় শুভকাজের জন্য উপযুক্ত নয়। আর ‘বোধন’ শব্দের মানে ‘উদ্বোধন, নিদ্রাভঙ্গকরণ, বা জাগানো’। ‘অকালবোধন’ শব্দবন্ধের অর্থ ‘পুজোর জন্য অসময়ে দেবী দুর্গার নিদ্রাভঙ্গকরণ বা জাগরণ, অসময়ে দেবী দুর্গার আরাধনা করা’।
বাল্মীকির রামায়ণে রামের দুর্গাপুজো করার কোনও বিবরণ নেই। কিন্তু রামায়ণের পদ্যানুবাদ করার সময় কৃত্তিবাস ওঝা কালিকাপুরাণ ও বৃহদ্ধর্মপুরাণ-এর কাহিনি একটু পরিবর্তন করে দিয়েছেন। রামায়ণে আছে, পিতার আদেশ পালন করার জন্য স্ত্রী সীতা ও ভাই লক্ষ্মণকে নিয়ে ১৪ বছরের জন্য বনবাসে যান রাজা দশরথের জ্যেষ্ঠপুত্র রামচন্দ্র। পঞ্চবটী বনে থাকাকালীন রামচন্দ্রের রূপে মুগ্ধ হয়ে প্রেম নিবেদন করেন রাক্ষসরাজ রাবণের বোন সূর্পনখা। কিন্তু সূর্পনখাকে প্রত্যাখ্যান করেন রামচন্দ্র। প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হলে সূর্পনখার নাক ও কান কেটে দেন রামচন্দ্র। বোনের অপমান সহ্য করতে পারেননি রাবণ। প্রতিশোধ নিতে ছদ্মবেশে সীতাকে অপহরণ করে নিয়ে যান রাক্ষসরাজ। আটকে রাখেন অশোকবনে।
সৌজন্যে - গুগল ইমেজ |
কৃত্তিবাসী রামায়ণ অনুসারে, রাবণ ছিলেন শিবভক্ত। শিব তাঁকে রক্ষা করতেন। ব্রহ্মা রামকে পরামর্শ দিলেন, দুর্গাপুজো করার। দুর্গাকে তুষ্ট করতে পারলে রাবণ বধ করে সীতা উদ্ধার করা সহজ হবে। কিন্তু দুর্গাপুজোর সঠিক সময় তো বসন্তকাল। শরৎকাল তো অকাল! তাছাড়া, অকালবোধনে দেবীর নিদ্রা ভাঙাতে হয় কৃষ্ণানবমীতে। কিন্তু ব্রহ্মা বলেন, রাবণকে বধ করতে চাইলে শুক্লা ষষ্ঠীতেই বোধন করতে হবে দেবীর।
হিন্দু পঞ্জিকা মতে, দুর্গাপুজোর বিধিসম্মত সময় চৈত্র মাস। বসন্তকালের পুজো বাসন্তীপুজো নামে পরিচিত। বসন্তকাল উত্তরাযণের অন্তর্গত। উত্তরায়ণে দেবতারা জাগ্রত থাকেন। বাসন্তীপুজোয় তাই বোধনের প্রয়োজন হয় না। হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, শরৎকাল হল দেবলোকের রাত্রি। ওই সময় দেবতারা ঘুমিয়ে থাকেন। তখন তাঁদের পুজো করার যথাযথ সময় নয়। তাই এই সময় পুজো করতে হলে বোধন বা জাগরণ করতে হয়। অকালের পুজো বলেই এর নাম ‘অকালবোধন’।
কালিকাপুরাণ ও বৃহদ্ধর্মপুরাণ অনুসারে, রাম-রাবণের যুদ্ধের সময় ব্রহ্মার পরামর্শে শরৎকালে দুর্গার পুজো করেন রামচন্দ্র। হিন্দু পুরাণে উল্লিখিত আছে, রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য দুর্গাপুজো করেছিলেন বসন্তকালে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ গ্রন্থে রয়েছে, রাজা সুরথ চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী ও নবমী তিথিতে শাস্ত্রবিধি মতে দেবী দুর্গতিনাশিনীর পুজো করেছিলেন।
সুরথ রাজা দুর্গার মাটির মূর্তি গড়ে পুজো করেছিলেন। রামচন্দ্রও তাই করলেন। আশ্বিন মাসের শুক্লা ষষ্ঠীর দিন কল্পারম্ভ, সন্ধ্যায় বেল গাছের তলায় বোধন, আমন্ত্রণ এবং অধিবাস।
রামচন্দ্র নিজের চোখ দুর্গাকে নিবেদন করতে গেলেন। সৌজন্যে - গুগল ইমেজ |
সায়াহ্নকালেতে রাম করিলা বোধন।
আমন্ত্রণ অভয়ার বিল্বাধিবাসন।।
আপনি গড়িলা রাম প্রতিমা মৃন্ময়ী।
সংগ্রামে হইতে দুষ্ট রাবণ বিজয়ী।।
আচারেতে আরতি করিলা অধিবাস।
বান্ধিলা পত্রিকা নব বৃক্ষের বিলাস।।
এইরূপে উদযোগ করিল দ্রব্য যত।
পদ্ধতি প্রমাণে আছে নিয়ম যেমত।।
বোধনের মন্ত্রে আজও বলা হয়,
ওঁ ঐং রাবণস্য বধার্থায় রামস্যানুগ্রহায় চ।
অকালে ব্রহ্মণা বোধো দেব্যস্তয়ি কৃতঃ পুরা।।
অহমপাশ্বিনে ষষ্ঠ্যাং সায়াহ্নে বোধয়মি বৈ।
বাংলা করলে যার মানে দাঁড়ায়, হে দেবী, রাবণবধে রামকে সাহায্য করার জন্য যেমন তোমার অকালবোধন করেছিলেন ব্রহ্মা, আমিও সেভাবে আশ্বিন মাসের ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় তোমার বোধন করছি।
নিয়ম মেনে বহুরকম বনফুল ও বনফলে বোধন, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী ও সন্ধিপুজো করলেন রামচন্দ্র। কিন্তু দেখা দিলেন না দেবী। তখন বিভীষণ উপদেশ দেন, ১০৮টি নীলপদ্ম দিয়ে দেবীর পুজো করার। সেই পরামর্শ মেনে, রাম ১০৮টি নীলপদ্ম দিয়ে মহানবমীর পুজো করার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে এত নীলপদ্ম? তখন, ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে দেবীদহ নামে এক হ্রদেই ফুটত নীল রঙের পদ্মফুল। কিন্তু লঙ্কা থেকে সে তো ১০ বছরের পথ। দেরি না করে রামভক্ত হনুমান উড়ে গেল সেই হ্রদে। তুলে আনল ১০৮টি নীলপদ্ম। কিন্তু পুজোর ফাঁকে রামচন্দ্রকে পরীক্ষা করার জন্য একটি ফুল লুকিয়ে রাখলেন দেবী। কী হবে এবার? ত্রুটি থেকে যাবে রামচন্দ্রের দেবী আরাধনায়? রাবণকে বধ করে উদ্ধার করা যাবে না সীতাকে? কিন্তু না, হারতে রাজি নন, রামচন্দ্র। একটি পদ্ম না পেয়ে তিনি নিজের একটি চোখ উপড়ে দুর্গাকে নিবেদন করতে গেলেন। কারণ, তাঁর চোখ ছিল পদ্মের মতো, তাই তাঁর নাম পদ্মলোচন। শেষমেশ আর চোখ উপড়ে দিতে হয়নি রামচন্দ্রকে। আবির্ভূত হয়ে ফিরিয়ে দেন লুকিয়ে রাখা নীলপদ্ম। রামকে বর দেন দেবী দুর্গা। রাক্ষসরাজ রাবণকে পরাজিত করে সীতাকে উদ্ধার করেন রামচন্দ্র।
শরৎকাল দেবপুজোর ‘শুদ্ধ সময়’ নয় বলে রামচন্দ্রের এই বোধন ‘অকালবোধন’ নামে পরিচিত। শাস্ত্রমতে বসন্তকাল দুর্গাপুজোর সঠিক সময় হলেও, শারদীয়া পুজোই প্রচলিত।
- Subscribe: https://www.youtube.com/c/RAJATKANTIBERA
- Blog: http://rajatkb.blogspot.com
- Google Plus: https://plus.google.com/u/0/
- Linkedin: https://www.linkedin.com/in/rajatkanti-bera-275134139/
- Facebook: https://www.facebook.com/rajatkanti.bera
No comments:
Post a Comment