নবীনের কাছে হারল নবীন
মিষ্টিযুদ্ধে বঙ্গের জয়,
কলিঙ্গর হাত থেকে রসের গোল্লাছুট!
নবীনচন্দ্র দাস |
বাগবাজারের নবীন দাস,
রসগোল্লার কলম্বাস।
লিখেছিলেন কমলকুমার মজুমদার। সেই লেখাতেই যেন সিলমোহর দিয়েছে ‘জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন রেজিস্ট্রি’।
নবীনের কাছে হেরেছে নবীন।
বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের সকালে বাংলার জন্য এসেছে মিষ্টি খবরটা। আইনি টানাপোড়েনে বাংলার শিল্পী নবীনচন্দ্র দাসের কাছে গো হারান হেরেছেন ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক।
রসগোল্লা তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?
বাংলা না, ওড়িশা?
২০১৫ সালের জুন মাসে হঠাত্ই বড় হয়ে ওঠে এই প্রশ্ন। রসগোল্লার মালিকানা চেয়ে কেন্দ্র সরকারের পেটেন্ট দফতরের কাছে আবেদন করে ওড়িশা। ‘জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন অফ গুডস’-এর দ্বারস্থ হয় নবীন পট্টনায়ক সরকার। সে বছরই সেপ্টেম্বরে জিআই স্বীকৃতির জন্য চেন্নাইয়ের জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন রেজিস্ট্রি’ বা জিআই-এর কাছে আবেদন করে পশ্চিমবঙ্গ। রসগোল্লার আঁতুড়ঘর কোথায়, তা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ-ওড়িশার মধ্যে দড়ি টানাটানি তুঙ্গে ওঠে। রসগোল্লা যে বাঙালিরই সৃষ্টি, এতদিন ধরে তা-ই জেনে এসেছে সবাই। কিন্তু ওড়িশার দাবি, রসগোল্লার জন্ম নাকি সেখানেই।
দাবির স্বপক্ষে কী যুক্তি দিয়েছে ওড়িশা?
তাদের দাবি, দ্বাদশ শতাব্দী থেকেই পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে রসগোল্লা ভোগ প্রচলিত। রসগোল্লার আসল নাম ক্ষীরমোহন। রথযাত্রার সময় ‘বচনিকা’ অনুষ্ঠানে লক্ষ্মী ঠাকুরকে এই মিষ্টি নিবেদন করা হয়। ভক্তরা বিশ্বাস করেন, প্রতি বছর উল্টো রথের পরের দিন লক্ষ্মীর মানভঞ্জন করতে জগন্নাথ তাঁকে রসগোল্লা খাওয়ান। উত্সবটি ৩০০ বছরের পুরনো। এতএব, ওড়িশাতেই জন্ম রসগোল্লার। রসগোল্লা আবিষ্কারের কৃতিত্ব অর্জনে মরিয়া ওড়িশা সরকার তিন-তিনটি কমিটিও তৈরি করে। প্রথম কমিটির কাজ ছিল, রসগোল্লার আবিষ্কার যে ওড়িশায় হয়েছে, এই দাবির প্রেক্ষিতে তথ্য-প্রমাণ খতিয়ে দেখা। দ্বিতীয় কমিটির কাজ ছিল, কীসের ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গ রসগোল্লা অবিষ্কারের কৃতিত্ব দাবি করছে, তা পর্যালোচনা করা। এবং তৃতীয় কমিটির কাজ ছিল, ওড়িশার দাবির স্বপক্ষে তথ্য সংগ্রহ করা।
বাংলাও পাল্টা দাবি করে, ক্ষীর দিয়ে তৈরি হয় ক্ষীরমোহন। ক্ষীরের গোল্লা বানিয়ে রসে ডোবানো হয়। আর রসগোল্লা তৈরি হয় ছানা দিয়ে। তাই ক্ষীরমোহন কখনওই রসগোল্লা নয়। ঐতিহাসিকরা জানান, নানা লেখায় রয়েছে, মায়ের ওপর রাগ করে চৈতন্য মহাপ্রভু নাকি মাঝে মধ্যেই পুরী চলে যেতেন। তাঁর জন্য বাংলা থেকে যেত বিশেষ ভোজ ‘রাঘব জালি’। সেই ভোজেই থাকত রসগোল্লা!
কোনও একটি সীমাবদ্ধ ভৌগলিক
ক্ষেত্রের মধ্যে উৎপন্ন কোনও
বিশেষ ধরনের জিনিসের স্বীকৃতি
হল এই জিআই রেজিস্ট্রেশন।
ক্ষেত্রের মধ্যে উৎপন্ন কোনও
বিশেষ ধরনের জিনিসের স্বীকৃতি
হল এই জিআই রেজিস্ট্রেশন।
পুরীর জগন্নাথ মন্দির ও প্রসাদ সম্পর্কিত নানা লেখা থেকে জানা যায়, এক সময় ছানাকে অপবিত্র বলে মনে করা হত। তাই প্রাচীন ভারতে ছানা দিয়ে তৈরি কোনও মিষ্টিই ভগবানের নিবেদনে লাগত না। এই নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেন পুরীর মন্দিরের পুরোহিতরা। তাই আগে দুধ ফুটিয়ে ক্ষীর তৈরি করে তার মধ্যে গুড় বা চিনি মিশিয়ে নাড়ু ও চাকতি তৈরি করা হত। ঐতিহাসিকদের একাংশের দাবি, জগন্নাথ মন্দিরে রসগোল্লা নয়, ব্যবহার হতো এই চাকতিই!
অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে, রসগোল্লার আবিষ্কার নিয়ে কোনও বিতর্ক থাকতে পারে না। তাঁদের দাবি, ১৮৬৪ সালে জোড়াসাঁকোতে একটি মিষ্টির দোকান খোলেন চিনি ব্যবসায়ী নবীনচন্দ্র দাস। ১৮৬৮ সালে তাঁর হাতেই জন্ম রসগোল্লার। তবে তখনকার রসগোল্লা এখনকার মতো দুধসাদা ছিল না। যত দিন গিয়েছে, রূপ খুলেছে রসগোল্লার। পরবর্তীকালে নবীনচন্দ্র দাসের ছেলে কৃষ্ণচন্দ্র দাস রসগোল্লাকে কৌটজাত করে বিক্রির উদ্যোগ নেন। এরপর কৃষ্ণচন্দ্র দাসের ছেলে সারদাচরণ দাস তৈরি করেন স্পঞ্জ রসগোল্লা। ওড়িশার দাবি একেবারেই ঠিক নয়।
শেষ পর্যন্ত ওড়িশার দাবি খারিজ করে দিয়েছে জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন বা জিআই। কিন্তু হেরেও হারতে রাজি নয় কলিঙ্গ। তাদের রসগোল্লারও জিআই রেজিস্ট্রেশনের দাবিতে সরব হয়েছে ওড়িশা। অন্যদিকে, সরকারি স্বীকৃতিতে উৎসাহিত হয়ে রসগোল্লার বিপণন বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছে নবান্ন। সরকারি সূত্রের খবর, ‘বাংলার রসগোল্লা’ নাম দিয়ে এই মিষ্টি বিপণনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ নিগম। তবে যে সব ব্যবসায়ী ‘বাংলার রসগোল্লা’ ব্র্যান্ড ও জিআই লোগো ব্যবহার করতে চান, তাঁদের একটি নির্দিষ্ট মাপকাঠি মেনে রসগোল্লা তৈরি করতে হবে। ওই রসগোল্লায় থাকবে ৬ গ্রাম
প্রোটিন ৪০ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ৬.৮ গ্রাম ফ্যাট এবং ২০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম। তবে নাম ছাড়া যে কেউ রসগোল্লা বিক্রি করতে পারেন। সেক্ষেত্রে তিনি ‘বাংলার রসগোল্লা’ ব্র্যান্ডটি ব্যবহার করতে পারবেন না।
- Subscribe: https://www.youtube.com/c/RAJATKANTIBERA
- Blog: http://rajatkb.blogspot.com
- Google Plus: https://plus.google.com/u/0/
- Linkedin: https://www.linkedin.com/in/rajatkanti-bera-275134139/
- Facebook: https://www.facebook.com/rajatkanti.bera
No comments:
Post a Comment