সান্তা ক্লজ আসলে কে?
কেন সে উপহার রেখে যায় মোজায় কিম্বা বালিশের নীচে?
সেন্ট নিকোলাস। সৌজন্যে- গুগল ইমেজ |
বড়দিনের অন্যতম আকর্ষণ সান্তা ক্লজ। সান্তা বলতে আমরা যাঁকে চিনি, তিনি বৃদ্ধ। শরীর ঢাকা লাল রঙের ঝোলানো পোশাকে, মাথায় লাল লম্বা টুপি। মাথার চুল ও দাড়ি একেবারে সাদা। কিন্তু কে এই সান্তা? কোথা থেকে এলেন? কেনই বা ঘরে ঘরে ঘুরে ঘুরে বাচ্চাদের উপহার দিয়ে যান? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের উঁকি দিতে হবে ইতিহাসের পাতায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের দিকে।
পাশ্চাত্য সংস্কৃতির কিংবদন্তী এই চরিত্রটি আসলে ছিলেন সেন্ট নিকোলাস নামে একজন ধর্মযাজক। ২৮০ সালের ১৫ মার্চ অধুনা তুরস্কের কাছে পাটারা গ্রামে জন্ম হয় সেন্ট নিকোলাসের৷ থাকতেন আজ আমরা যাকে টার্কি বলি সেই দেশে৷ ভারি দয়ালু এই মানুষটি ছিলেন সবার প্রিয়৷ সাহায্য করতেন বিপদে-আপদে৷ নিজের ধনসম্পদ ব্যয় করতেন অসহায় গরিব মানুষের সাহায্যে। এই মহানুভবতার জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। শোনা যায়, একবার দাসী হিসেবে বিক্রি হয়ে যাওয়া তিনটি মেয়েকে রক্ষা করে তাঁদের বিয়ে ও যৌতুকের সব খরচ বহন করেন সেন্ট নিকোলাস। শুধু তাই নয়, এও শোনা যায়, নিকোলাস ২৪ ডিসেম্বর সন্ধে থেকে মাঝ রাত পর্যন্ত বাড়ি বাড়ি ঘুরে উপহার দিতেন ছোটদের। সেন্ট নিকোলাসের ডাচ ডাকনাম ছিল সিন্টার ক্লাস৷ সেই থেকে সান্তা ক্লজ৷ কিন্তু এখন আমরা রঙিন পোশাক পরা যে সান্তা ক্লজকে দেখি, তখনকার সেন্ট নিকোলাস তেমন কোনও পোশাক পরেননি। লাল টুকটুকে জামা পরা মোটাসোটা একটা বুড়োর পিছনে যে এরকম গল্প আছে, সেটা অবশ্য অনেকেরই অজানা৷
১৭৭৩-৭৪ সালে নিউ ইয়র্কের একটি সংবাদপত্রে সেন্ট নিকোলাস সম্পর্কে খবর ছাপা হয়৷ আঠারো শতকে মার্কিন মুলুকে প্রবেশ সেন্ট নিকোলাসের৷ ১৮২৩ সালে ক্রিসমাস ডে উপলক্ষে আমেরিকার বিখ্যাত লেখক ক্লেমেন্ট ক্লার্ক মুর লেখেন ‘A visit from St. Nicholas’ কবিতা। সেই কবিতাতেই সান্তার পোশাকের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। আজকের সান্তা ক্লজের রঙিন পোশাকের সূচনা সেই কবিতা থেকে। যা পরবর্তী কালে বিভিন্ন বদলের মধ্যে দিয়ে আজকের এই রূপ পেয়েছে। এক সন্ত আটটি হরিণে টানা গাড়িতে করে উড়ে উড়ে বাচ্চাদের উপহার দিচ্ছেন—এমন ছবিই ফুটে ওঠে সেই কবিতায়। ১৮৮১ সালে থমাস ন্যাসট নামে এক আমেরিকান কার্টুনিস্টের আঁকা সান্তার ছবি প্রকাশিত হয় ‘হার্পারস উইকলি’ পত্রিকায়। সেখানেই সান্তা ক্লজের এই লাল পোশাক খ্যাতি পায়। লাল টুপি মাথায়, শরীর ঢাকা সাদা ফার লাগানো লাল পোশাকে হরিণ-টানা গাড়িতে চড়ে চলেছেন সান্তা। কাঁধে উপহারভর্তি ঝোলা। রাত শেষ হওয়ার আগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বাচ্চাদের উপহার বিলি করছেন তিনি। থমাস ন্যাসটের আঁকা এই ছবি বিশ্বে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। তারপর থেকেই সারা বিশ্বে ক্রিসমাস ডে-র আগের রাতে ছোটদের উপহার দেওয়ার প্রচলন হয়। ছড়িয়ে পড়ে নানা রূপকথা। ছোটরা বিশ্বাস করতে শুরু করে, সান্তা ক্লজ জাদু জানে। জাদুর জোরে উড়ে এসে তাদের নানা রকম উপহার দিয়ে যায়।
সান্তা আসে স্লেজে চেপে৷ স্লেজ টানে রেইন ডিয়ার৷ ছবি - লেখকের তোলা |
সান্তা ক্লজকে ঘিরে একেক দেশে একেক রকম গল্প৷ কেউ বলে সান্তা থাকে চির তুষারের দেশে৷ সঙ্গে থাকে তার মোটাসোটা বউ৷ অনেকের মতে আবার সান্তার অনেকগুলো পোষা ভূত আছে৷ বড়দিনের আগে তারাই নাকি সান্তাকে খবর দেয় কে দুষ্টুমি করছে আর কে লক্ষ্মী হয়ে আছে৷ শোনা যায়, সে কথা শুনে সে একটা লিস্ট বানায়। লিস্টের একপাশে থাকে দুষ্টু শিশুদের নাম-ঠিকানা, অন্য পাশে থাকে শান্তশিষ্ট, লক্ষ্মী বাচ্চাদের নাম-ঠিকানা। একাজে সান্তাকে সাহায্য করে পরীরা। পরীরাই তাঁর সব উপহার তৈরি করে দেয়। সান্তা ক্লজ আসে স্লেজে চেপে৷ স্লেজ টানে রেইন ডিয়ার৷ আর সেই স্লেজেই রঙচঙে ফিতে বাঁধা প্যাকেটে থাকে নানা রকম গিফট৷ যে লক্ষ্মী হয়ে থাকে, তার ঝোলানো মোজার মধ্যে বা বালিশের নীচে উপহার রেখে আসে বুড়ো-নাদুসনুদুস সান্তা দাদু। আর দুষ্টু ছেলেদের জন্য কাঠ কয়লা।
সান্তার জন্য আছে ফিরতি উপহারও। আমেরিকা ও কানাডায় শিশুরা সান্তার জন্যে রেখে দেয় এক গ্লাস দুধ ও এক প্লেট বিস্কুট। ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ায় সান্তা ক্লজকে দেওয়া হয় বিয়ার অথবা মিষ্টি পিঠে। ডেনমার্ক, নরওয়ে ও সুইডেনে দেওয়া হয় পায়েশ, দারুচিনি। আয়ারল্যান্ডে সান্তার জন্যে আলাদা করে রাখা হয় ক্রিসমাসের বিশেষ পুডিং ও দুধ।
কলকাতা থেকে ক্যালিফোরনিয়া৷ ছবিটা একই৷ লাল জোব্বা৷ লাল টুপি৷ সাদা দাড়ি৷ উপহার হাতে সান্তা৷ ছোট থেকে বড়-বুড়ো৷ সময় পাল্টেছে৷ কিন্তু, সান্তা একই রকম৷ একটু মোটাসোটা৷ কিন্তু এ বার কি সান্তাও পাল্টে যাবে? মার্কিন মুলুকে না কি অনেকে তেমনটাই চাইছেন৷ অনেকে না কি চাইছেন, সান্তা একটু রোগা হোক৷ একটু ছিপছিপে৷ অথবা মাসকুলার৷ কেন? তাঁদের যুক্তি, সান্তা সব বাচ্চাদের রোল মডেল৷ নিজের রোল মডেলকে অত মোটাসোটা দেখতে না কি অনেকেই পছন্দ করে না৷ তাছাড়া, রোল মডেল যদি মোটা হয়, তা হলে বাচ্চারাও তাঁকে দেখে মোটা হতে চাইবে৷ মেদ ঝরাতে বললেই হয়ত বলবে, এই বেশ ভাল আছি৷ সান্তা ক্লজ তো মোটা৷ তার থেকে ভাল আর কে আছে? আমিও সান্তা ক্লজের মতোই থাকব৷
এর উল্টো মতও জোরালো৷ অনেকেরই মত, সব জিনিস পাল্টে দেওয়া ঠিক নয়৷ সান্তা, সান্তার মতোই থাকুক৷ গোলগাল৷ একসময়, অতিরিক্ত ওজনকে মানুষ প্রাচুর্য ও বৈভবের প্রতীক হিসেবে মনে করত৷ তাছাড়া, কে বলল, মোটা মানেই আনফিট? বিশ্বজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সান্তা দাদু৷ ঘরে ঘরে গিয়ে তুলে দিচ্ছে উপহার৷ তাঁর ফিটনেস নিয়ে কি প্রশ্ন তোলা যায়৷ তাই সান্তা, এরকমই থাকুক৷ সান্তার অমন সুপুরুষ হয়ে কাজ নেই৷
সান্তা মানেই বড়দিন৷ সান্তা মানেই মোজার মধ্যে বা বালিশের তলায় উপহার৷ সান্তা মানেই ডিসেম্বরের শীতে দাঁড়ির ফাঁকে হাসি মুখে ঘুরে বেড়ানো বুড়ো৷ সান্তা আন্তর্জাতিক৷ সান্তা আনন্দের পথের পথিক৷ সান্তা অপ্রতিদ্বন্দ্বী৷ শোনা যায়, একটা সময় নাকি সান্তারও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল৷ তারাও সান্তার মতো উপহারের ঝুলি নিয়ে ঘুড়ে বেড়াত সুইৎজারল্যান্ড, জার্মানিতে৷ কেউ বলে ক্রীস্টকাইন্ড৷ কেউ বলে ক্রিস ক্রিঙ্গল৷ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলিতে জনপ্রিয় ছিল জুলটোমটেন৷ সান্তার মতো সেও সবাইকে
উপহার দিত৷ ব্রিটিশদের ছিল ফাদার ক্রীস্টমাস৷ বাচ্চাদের জন্য তার ঝুলিতেও থাকত হাজারো গিফট৷ ফ্রান্সের ছিল পিয়ার নোয়েল৷ রাশিয়ায় শিশুদের বিছানায় উপহার রেখে দিত এক বৃদ্ধা, বাবোউস্কা৷ ইটালিতেও এরকমই এক বৃদ্ধার গল্প প্রচলিত৷ লা বেফানা৷ কিন্তু এদের সবাইকে পিছনে ফেলে সান্তা এখন সবার কাছের৷ সান্তার বাস বিশ্বজুড়ে৷ শিশু মনের মনের মানুষ সান্তা ক্লজ৷ সে পঁচিশের সকালে বালিশের তলায় কিছু থাকুক আর না-ই থাকুক৷
- Subscribe: https://www.youtube.com/c/RAJATKANTIBERA
- Blog: http://rajatkb.blogspot.com
- Google Plus: https://plus.google.com/u/0/
- Linkedin: https://www.linkedin.com/in/rajatkanti-bera-275134139/
- Facebook: https://www.facebook.com/rajatkanti.bera
No comments:
Post a Comment