Thursday, January 18, 2018

500 years old Fish Fair in Debanandapur, Hooghly, West Bengal

মাঘের শীতে মাছের মেলা

৫০০ বছরের পুরনো উত্‍সবে জমজমাট হুগলির দেবানন্দপুর

মাছের মেলায় মেলা মাছ....


সন্ন্যাসী হয়েও ছেলে ফিরে এসেছিল ৯ মাস পর। সেই আনন্দে প্রজাদের মত্স্যমুখ করিয়েছিলেন জমিদার। দিনটা ছিল পয়লা মাঘ। শোনা যায়, সেই থেকেই শুরু হয়েছিল মাছের মেলা। হুগলির দেবানন্দপুরে, আজ থেকে ৫০০ বছর আগে।


'ভাত-মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙ্গালি সকল
ধানে ভরা ভূমি তাই মাছ ভরা জল।'
                                        - ঈশ্বর গুপ্ত

... সে দিন যে গেছে চলে...।

সেই ‘মাছ ভরা জল’ও নেই, সেই সব মাছেরাও নেই!! ছিপ, পলুই বা ছাঁকনি জাল ফেলে মাছ ধরার সেই মহাধুম লুপ্তপ্রায়।

‘মৎস্য ধরিব খাইব সুখে’-র দিন বদলে হয়েছে ‘মৎস্য কিনিব খাইব সুখে’। হারিয়ে যেতে বসা সব মাছ চোখে দেখতে বা চেখে দেখতে ভরসা বিভিন্ন মেলা।



যেমন, হুগলির দেবানন্দপুরের কেষ্টপুর।
জি টি রোডের আদিসপ্তগ্রাম থেকে দেবান্দপুর মোড়ে গেলেই দেখা যাবে, একটা লাল মাটির পথ বেঁকে গিয়েছে কৃষ্ণপুরের দিকে। হারিয়ে যাওয়া সরস্বতী নদী এক সময় এই অঞ্চল দিয়ে বইত। সেই নদী তীরের জায়গাটাকে লোকে কেষ্টপুর বলে ডাকে।

মাছের মেলায় মেলা মাছ....। রুই, কাতলা, পাবদা, ইলিশ, চিংড়ি তো আছেই। ছোটখাটো পুঁটি, চ্যাং, ল্যাটার পাশাপাশি আছে পেল্লাই ভেটকি থেকে আড়। শাল, শোল থেকে শঙ্কর, কালবোস। হরেক রকম ভেটকি--ভোলা ভেটকি, কই ভেটকি, চাঁদা ভেটকি। সঙ্গে নানা রকম গুড়জালি, হালুয়া, কয়েক ফুট লম্বা পাঙ্গাস, গানদাস, রূপচাঁদা,পায়রা চাঁদা। এক সময়ে এখানে দেখা যেত বাঙ্গোস, কাকলেশ, বান, গুঁতে, পাঁকালের মতো বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির কিছু মাছও।

মেলার বয়স আনুমানিক ৫০০ বছর।
গ্রামের কাছেই ইতিহাস বিখ্যাত সপ্তগ্রাম বন্দর। তখন সপ্তগ্রামের রাজা ছিলেন হিরণ্যদাস মজুমদার। তাঁর ভাই গোবর্ধন গোস্বামীর ছেলে রঘুনাথ। কিন্তু সংসার ও ধনদৌলতে তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। ধমর্প্রাণ বালকটি মাত্র পনেরো বছর বয়েসে পায়ে হেঁটে পুরী চলে যান।

দেবানন্দপুরের জমিদার গোবর্ধন গোস্বামীর তখন বিশাল নাম-ডাক। শোনা যায়, দিল্লির নবাবকে তখনকার দিনেই বছরে ১২ লক্ষ টাকা খাজনা দিতেন তিনি। কিন্তু তাঁরই ছেলে যদি সংসার ছেড়ে সন্ন্যাসী হন, তাহলে এতবড় জমিদারি কে দেখবে? চিন্তায় পড়ে যান গোবর্ধন। পুরীতে গিয়ে রঘুনাথের দেখা হয় নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর সঙ্গে। মহপ্রভুর আদেশেই তিনি ৯ মাস পর এক ১লা মাঘে ফিরে আসেন। সেই আনন্দে প্রজাদের মাছ-ভাত খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেন জমিদার। কিন্তু সুযোগ বুঝে রঘুনাথকে পরীক্ষা করার জন্য গ্রামবাসী বৈষ্ণবরা অসময়ে ইলিশ মাছের ঝোল ও আমের টক খাওয়ার বায়না ধরেন। কিন্তু শীতের সময় ইলিশ মাছ বা আম মিলবে কোথায়? বিপদ বুঝে কৃষ্ণনাম জপ করতে লাগলেন রঘুনাথ। জাল ফেলা হল সরস্বতী নদীতে। পড়ল বড় বড় দু’টি ইলিশ মাছ। শোনা যায়, একটি আম গাছে কিছু আমও মেলে। অবাক হয়ে যান গ্রামবাসীরা। সবই রাধা-কৃষ্ণের লীলা বলে ধ্বনি তোলেন সবাই। প্রতিষ্ঠা করা হয় মন্দির। একটি  সেই মন্দির চত্বরেই পাত পেড়ে মাছ-ভাত খান প্রজারা।
তারপর থেকেই ১লা মাঘ মেলা বসে মন্দির চত্বরে। মাছের মেলা।

শোনা যায়, মাছের নানা পদ তৈরির জন্য পরবর্তীকালে স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ গোস্বামী বাড়ি সংলগ্ন মাঠে মাছমেলার আয়োজন করেছিলেন। তার পর থেকে প্রতি বছর মাঘ মাসের প্রথম দিনই একদিনের মাছ মেলা বসে। সকাল থেকে শুরু করে মেলা চলে রাত পর্যন্ত। শুধু হুগলি নয়, আশেপাশের সব জেলা থেকেই আসেন ক্রেতা-বিক্রেতারা। দিনভর চলে মাছের বিকিকিনি। দূর থেকে আসা লোকজন তো মাছ কিনে শুরু করে দেন চড়ুইভাতি। শুধু মাছ নয়, সংসারের নানা জিনিসও বিক্রি হয় ওই মেলায়।

মাছ কেনার পাশাপাশি অনেকে পুজোও দেন মন্দিরে।
হয়তো প্রার্থনা করেন, আমার সন্তান যেন থাকে মাছে-ভাতে!





No comments:

Post a Comment

Popular Posts

বাংলার ঘরে ঘরে আজ শিবরাত্রি পুরাণ মতে, শিবকে পতি রূপে পাওয়ার জন্য রাত জেগে উপবাস করে শিবের আরাধনা করেছিলেন দেবী পার্বতী৷ তারপর থেকেই ...