Monday, January 1, 2018

Shimla to Manali in a car - 2

মানালির পথে- ২

তারপর যে-তে যে-তে যে-তে, 
এক নদীর সঙ্গে দেখা...


পায়ে তার ঘুঙুর বাঁধা
পরনে
উড়ু-উড়ু ঢেউয়ের
নীল ঘাগরা।
                - যেতে যেতে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়

কবির নদীর নাম জানি না। আমার সঙ্গে যে নদীর দেখা হল, সে নদীর নাম বিপাশা। দেখা হল মাণ্ডিতে।

সিমলা থেকে সকাল ৯টা ৪৫-এ বেরিয়ে মানালি পৌঁছতে সন্ধে প্রায় সাড়ে ৬টা বেজে গিয়েছিল। তার দুটো কারণ। এক, শুরু থেকেই চালককে বলে দিয়েছিলাম, তাড়াহুড়ো একদম নয়। আর দুই, রাস্তায় যে-তে যে-তে ৭টি জায়গায় থেমেছিলাম আমরা। 

১. সুন্দরনগর লেক-
সুন্দরনগরের সু্ন্দর লেক। ছবি - লেখকের তোলা
জায়গাটার নাম সুন্দরনগর, আকর্ষণের কেন্দ্রে সু্ন্দর একটি লেক। প্যান্ডো বাঁধের জলকে ১৩ কিলোমিটার লম্বা টানেল দিয়ে এনে জমা করা হয় বাগগিতে। সেখান থেকে ১১ কিলোমিটার লম্বা খাল বেয়ে জল এসে জমা হয় সুন্দরনগরের এই কৃত্রিম জলাশয়ে। লেকের জল ফের ১৩ কিলোমিটার লম্বা টানেল দিয়ে পৌঁছে যায় বিলাসপুর জেলার শতদ্রু নদীর পাড়ে দেহরে, সেখানে টার্বাইন ঘোরানোর পর তার ছুটি। 
চণ্ডীগড়-মানালি ২১ নম্বর জাতীয় সড়কের ওপর এই শহর হিমাচল প্রদেশের মাণ্ডি জেলায় অবস্থিত। শোনা যায়, বাংলার সেন রাজবংশের পূর্বপুরুষ রাজা বীর সেন এই জায়গাটি আবিষ্কার করেন। সুন্দরনগর, আগে পরিচিত ছিল সাকেত রিয়াসত নামে। সাকেত নামটি ঋষি শুকদেব-এর নাম থেকে এসেছে। বিশাল জলাশয়ের চারপাশ সুন্দর করে বাঁধানো। সুন্দর বসার জায়গা। সিমলা থেকে ১১০ কিমি দূরের এই লেক-এ আমরা যখন পৌঁছলাম, ঘড়িতে তখন দুপুর ১ টা ৪৫। সুন্দরনগরে নাকি ছবি তোলা বারণ। কিন্তু সেই বিধিনিষেধ চোখে পড়ার আগেই কয়েকটা ছবি তোলা হয়ে গেল। বেশ বুঝতে পারছিলাম, বিকেলে এই লেকের পাশে বসে সময় কাটানোটা কী অসাধারণ হতে পারে! 




২. মাণ্ডি- 
মাণ্ডির গুরুদ্বার ...। ছবি - লেখকের তোলা
পাহাড় আর জঙ্গলে ঘেরা এই জায়গাটিকে খুঁজে বের করেছিলেন আজবের সেন নামে এক রাজা। সেটা ১৫২৬ সালের কথা। পরে ১৮৩৯ সালে জায়গার দখল নেন মহারাজা রঞ্জিত সিংহ। গড়ে ওঠে শিখদের জনবসতি। তাঁর মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে এলাকায় শিখদের ক্ষমতা কমে আসে। স্বাধীনতার পর ১৯৪৮ সালে মাণ্ডি ভারতের অংশ হয়। আগের নাম ছিল মাধবনগর বা শহোর, এখন মাণ্ডি। জনসংখ্যার বিচারে হিমাচলপ্রদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। 
মাণ্ডির অসাধারণ গুরুদ্বার চোখ জুড়িয়ে দেয়। আসলে মাণ্ডিতে হিমাচলবাসীদের পাশাপাশি এখনও শিখদের সংখ্যা কম নয়। আছে ৮১টি মন্দির। তাই বিপাশা নদীর তীরে অবস্থিত মাণ্ডির পরিচিতি ‘পুবের বারাণসী’ হিসেবে। এখান থেকে কুলুর দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার। যাঁরা ট্রেক করতে ভালবাসেন তাঁদের কাছেও আকর্ষণীয় মাণ্ডি। রেওয়ালসর, শিকারিদেবী, ব্যারট, ঝাটিংরি, কার্শং অনেকগুলি ট্রেকিং পয়েন্ট আছে। মাণ্ডিই সেই সব জায়গার মধ্যে একটি যেখানে এখনও বাণ্ডি খেলা 
হয়। খেলাটা অনেকটা হকির মতো। 
       সুন্দরনগর থেকে দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। মাণ্ডিতে যখন পৌঁছলাম, তখন ঘড়িতে আড়াইটে। সিমলা থেকে মানালির পথে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের শুরু এখান থেকেই। মাণ্ডিতে পৌঁছেই দেখা হল বিপাশা নদীর সঙ্গে। তারপর মানালি পর্যন্ত সে বয়ে চলল ডান দিকে। 
সে নদীর দু’দিকে দু’টো মুখ।
এক মুখে সে আমাকে আসছি বলে
দাঁড় করিয়ে রেখে
অন্য মুখে
ছুটতে ছুটতে চলে গেল...
                                                     - যেতে যেতে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়




৩. প্যাণ্ডো ড্যাম-
পাহাড়ের মধ্যে বিয়াসের জল। ছবি - লেখকের তোলা
মাণ্ডি থেকে ১২ কিলোমিটার এগোলেই সামনে এক বিশাল জলাধার। প্যাণ্ডো ড্যাম। পাহাড়ের মধ্যে বিয়াসের জলকে আটকে রেখে ব্যবহারের ব্যবস্থা। জলাধারের ওপরের সেতু দিয়ে ছুটছে আমাদের গাড়ি। জানালার দু’পাশে অসাধারণ ফ্রেম। ক্যামেরা বের করতেই হাঁ হাঁ করে উঠলেন চালক। কারণ, এখানে ছবি তোলা একেবারে নিষেধ। ধরা পড়লে মোটা অঙ্কের জরিমানা তো হবেই, ক্যামেরাটাও যেতে পারে। তবে পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে গোটা ড্যামের প্যানোরামিক ভিউ মন ক্যামেরায় বন্দি করতে অবশ্য কেউ বাধা দেবে না। ১৯৭৭ সালে ড্যামটি তৈরি হয়। আসল কাজ জলবিদ্যুত্‍ তৈরি। বিয়াস থেকে জমা হওয়া জল, ৩৮ কিলোমিটার পাইপ লাইনের মাধ্যমে নিয়ে যাওয়া হয় দেহর জলবিদ্যুত্‍ কেন্দ্রে। তারপর ওই জল ফেলে দেওয়া হয় সতলুজ নদীতে। ৯৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি হয় দেহর প্রাওয়ার প্রজেক্টে। 

৪. হানোগি মাতার মন্দির- 


মাণ্ডি থেকে ১২ কিলোমিটার গেলে রাস্তার ওপর ডানদিকে হানোগি মাতার মন্দির। যখন পৌঁছলাম ঘড়িতে ৩টে। বাতাসে বেশ শীত শীত ভাব। গাড়ি থেকে নামতেই যেন ছেঁকে ধরল পাহাড়ি ঠান্ডা। কাঁপা কাঁপা হাতে মন্দিরের ঘণ্টা বাজিয়ে প্রসাদ নিলাম। সামনেই পাথরের হিন্দু দেবী মূর্তি। ক্যামেরার লেন্স খুলতেই গম্ভীর ভাবে হাত নেড়ে নিষেধ করলেন পুরোহিত। এখানেও ছবি তোলা মানা! মন্দিরের নীচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সুন্দর একটা ঝরনা, পাশ দিয়ে বিয়াস। দূর থেকেও হানোগি মাতার মন্দির দেখতে দারুণ লাগে। বেশি দেরি না করে মন্দিরের বাইরের কয়েকটা ছবি তুলে গাড়িতে উঠে পড়লাম। চালক জানালেন, এখানেও ট্রেকিং ও রক ক্লাইম্বিং-এর ব্যবস্থা আছে।




৫. অট টানেল-
হানোগি মাতার মন্দির থেকে মাত্র ২২ কিলোমিটার, তারপরই অট টানেল। একটা অসাধারণ অভিজ্ঞতা (পরের লেখায় বিস্তারিত লিখব)। পৌঁছতে প্রায় পৌনে চারটে বেজে গেল। টানেলে ঢোকার ঠিক আগে ডানদিকে যে রাস্তাটা চলে গিয়েছে, সেটা আপনাকে নিয়ে যাবে জালোরি পাস, সেখান থেকে সিমলা জেলার রামপুর। বিশাল পাহাড় ফুঁড়ে তৈরি করা হয়েছে ২.৮ কিলোমিটার লম্বা সুড়ঙ্গ। পৃথিবীর যে সব সড়ক-সুড়ঙ্গ সবচেয়ে বিপজ্জনক, হিমাচলের অট টানেল সেগুলির একটি। ভারতের সবচেয়ে লম্বা রোড টানেল। টানেল শেষ হলেই শুরু হয় কুলু জেলা। এখান থেকে কুলু শহর মাত্র ২৯ কিলোমিটার, ৬৯ কিলোমিটার পরে মানালি। 

৬. কুলু- 

বিকেল ৪টে ২৪। এসে গেল কুলু। ভ্যালি অফ গডস। সমুদ্র তল থেকে ১২৩০ মিটার উঁচু। কথিত আছে, মুনিঋষিদের আখড়া ছিল আজকের কুলু বা সেকালের কুলুত উপত্যকায়। কুলুকে ঘিরে বয়ে চলেছে শতদ্রু, বিয়াস, মেহু, সরোবরী, পার্বতী, চন্দ্রভাগার মতো পাহাড়ি নদী। ঋতুর সঙ্গে বদলে যায় ফুল-ফলের সৌন্দর্য। ফল বলতেই মনে পড়ল, আপেলের কথা। সিমলায় গাছে আপেল দেখা হয়নি। কুলুতেও দেখলাম রাস্তার দু’ধারে আপেলের খালি গাছ। সারি দেওয়া কুলু শালের দোকান। বেলা ফুরিয়ে আসছে, তাই ইচ্ছে থাকলেও দাঁড়ালাম না। আপনাদের হাতে সময় থাকলে কুলু থেকে কিনতে পারেন বিখ্যাত শাল।
একটা কথা, কখনও যদি দুর্গাপুজোর সময় কুলুতে বেড়াতে যান, তাহলে মিস করবেন না দশেরা উত্‍সব। কুলুর এই উৎসব পৃথিবী বিখ্যাত। তখন কুলুর সাজই আলাদা। বিচিত্র সব বাজনার তালে জমে ওঠে দশেরা। দেবী হিড়িম্বা থেকে মালানা গ্রামের দেবতা জমলুও যোগ দেন এই উৎসবে। আর যদি কুলুতে না থাকেন, কুলু হয়ে মানালি যাওয়ার পথে থামার মতো ঘণ্টাখানেক হাতে সময় থাকে, তাহলে অবশ্যই বিপাশা নদীতে রাফটিং করবেন। মজাই আলাদা!

৭. বৈষ্ণোদেবী মন্দির-
মানালি যাওয়ার পথে পড়বে বৈষ্ণোদেবী মন্দিরও। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন, বৈষ্ণোদেবী মন্দির। জম্মুর বিখ্যাত মন্দিরের আদলে তৈরি বলেই এই নাম। প্রায় সন্ধে নেমে গিয়েছিল বলে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মন্দিরের দরজা। অনুনয়-বিনয়ে দরজা খুলল। মন্দিরটির আসল নাম মহাদেবী টেম্পল। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, বৈষ্ণোদেবী মন্দির। অপূর্ব কারুপকার্য মন্দিরের গায়ে। সিঁড়ি উঠে গেছে প্রায় তিনতলা পর্যন্ত। সেখান দিয়ে ওপরে উঠলেই মন্দিরের ভিতরের অংশে চার পাশের দেওয়ালে ও ছাদে কাঠের কাজ দেখে চোখ রফেরানো যায় না।  দেবী-দর্শন করে মানালিকে দেখার জন্য পাড়ি দিলাম বাকি পথ।

সাবধান!-
মাণ্ডি থেকে মানালি পর্যন্ত ভয়ঙ্কর সুন্দর বিপাশা। কিন্তু সেই সৌন্দর্যের টানে কখনওই গাড়ি ছেড়ে নদীতে নেমে পড়বেন না! কারণ এই নদীর এই অংশেই দুর্ঘটনা ঘটেছে সব থেকে বেশি। ২০১৪ সালের ৮ জুন, ২৪ জন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া নদীতে নেমে ছবি তুলছিলেন। হঠাত্‍ আসে হড়পা বান। ভেসে যান সবাই। পরে সবার দেহ উদ্ধার হয়। 

শেষ কথা-
সিমলা থেকে মানালি সড়কপথে দূরত্ব ২৬৫ কিলোমিটার, আকাশে ১২৮ কিলোমিটার। সরকারি ও বেসরকারি সরাসরি বাস প্রচুর আছে। বাসে গেলে খরচ খুব কম। গাড়ি ভাড়া করলে খরচ অনেকটা বেশি ঠিকই, বাসের তুলনায় মজাও বহুগুণ বেশি। সিমলা থেকে মানালি গেলে সকাল সকাল রওনা হওয়ার চেষ্টা করুন। তাহলে রাস্তার দেখার জায়গাগুলো সময় দিয়ে দেখতে পারবেন। সন্ধের আগে পৌঁছতে পারবেন মানালিতে।





No comments:

Post a Comment

Popular Posts

বাংলার ঘরে ঘরে আজ শিবরাত্রি পুরাণ মতে, শিবকে পতি রূপে পাওয়ার জন্য রাত জেগে উপবাস করে শিবের আরাধনা করেছিলেন দেবী পার্বতী৷ তারপর থেকেই ...