Sunday, April 15, 2018

Gajan: a Hindu Folk festival celebrated mostly in West Bengal.

চৈত্র সংক্রান্তিতে শিবের গাজন: 
এক লুপ্তপ্রায় বাংলার লোক উত্‍সব

বাংলাদেশের গাজন। সৌজন্যে - গুগল ইমেজ


‘আমরা দু’টি ভাই শিবের গাজন গাই।
ঠামমা গেছে গয়া-কাশী ডুগডুগি বাজাই।।’
ছোটবেলায় চৈত্রের দুপুরগুলো ছিল একেবারে অন্যরকম। বেলা গড়িয়ে দুপুর নামলেই খাঁ খাঁ করত গ্রামের রাস্তাঘাট। অনেক দূর থেকে শোনা যেত বাসনওয়ালার থালা বাজানোর শব্দ বা কোনও শিব-ভক্তর ডুগডুগির আওয়াজ। সারা চৈত্র মাস জুড়ে তাঁরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভিক্ষে করতেন। কোনও কথা বলতেন না, মুখে একটা খড়কুটো চেপে ধরে সারাদিন ঘুরে বেড়াতেন। দুয়ারে এসে ডুগডুগি বাজিয়ে জানান দিতেন, ভিক্ষে চাই। সারা মাস এভাবে ভিক্ষে করার পর চৈত্র সংক্রান্তির গাজনে অংশ নিতেন তাঁরা। সেই গাজন দেখার জন্য আমরাও সারা মাস অপেক্ষা করে থাকতাম। সংক্রান্তির দিন বিকেল বিকেল ভিড় করতাম হাইস্কুলের কাছে গাজনতলায়। 

গাজনের সন্ন্যাসী বা ভক্তরা নিজেদের শরীরকে বিভিন্ন উপায়ে যন্ত্রণা দিয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে ইষ্ট দেবতাকে সন্তুষ্ট করা চেষ্টা করেন। গাজন উপলক্ষ্যে তাঁরা শোভাযাত্রা সহকারে দেবতার মন্দিরে যান। শিবের গাজনে দু'জন সন্ন্যাসী শিব ও গৌরী সেজে এবং অন্যান্যরা নন্দী-ভৃঙ্গী, ভূতপ্রেত, দৈত্যদানবের সং সেজে নাচ-গান করতে থাকেন। চৈত্রসংক্রান্তির গাজনে কালী নাচ উল্লেখযোগ্য। ধর্মের গাজনের বিশেষ অঙ্গ হল নরমুণ্ড বা শব নিয়ে নৃত্য বা মড়াখেলা। জৈষ্ঠ মাসে মনসার গাজনে মহিলা সন্ন্যাসী বা ভক্ত্যারা অংশ নেব, তাঁরা চড়কের সন্ন্যাসীদের মতোই অনুষ্ঠান করেন। চড়ক পুজো পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক লোক উৎসব। চৈত্রের শেষ দিনে শিবের মন্দিরে আয়োজন করা হয় বিশেষ অনুষ্ঠানের। আধুনিক নানা উত্‍সবের মাঝে কলকাতা ও জেলার বিভিন্ন প্রান্তে এখনও পালিত হয় দিনটি। চৈত্র সংক্রান্তির উৎসবকে কেন্দ্র করে যে মেলা বসে, তাকে বলে চড়ক সংক্রান্তির মেলা। উত্‍সব চলে নববর্ষের প্রথম দু-তিন দিন ধরে। এই উত্‍সবেরই অঙ্গ শিবের গাজন। 

গাজন শব্দটি এসেছে  গাঁ, অর্থাৎ গ্রাম এবং জন অর্থাৎ জনগণ থেকে। গ্রামের জনগণের নিজস্ব উৎসবই হল গাজন। অন্য মতে, এই উৎসবে অংশগ্রহণকারী সন্ন্যাসীরা প্রচণ্ড গর্জন করেন বলে উৎসবের এই নামকরণ। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, গাজন উৎসবের দিনে দেবী দুর্গার সঙ্গে শিবের বিবাহ হয়। বিবাহ উৎসবে সন্ন্যাসীরা বরযাত্রী হিসেবে অংশ নেন। জনশ্রুতি রয়েছে, ১৪৮৫ খ্রিষ্টাব্দে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামের এক রাজা এই উৎসব প্রথম প্রচলন করেন। চৈত্র মাস থেকে বর্ষার শুরু পর্যন্ত সূর্য যখন প্রচণ্ড অগ্নিময় রূপ ধারণ করে, তখন সূর্যের তেজ কমানো ও বৃষ্টির আশায় কৃষিজীবী মানুষ এই পূজা অনুষ্ঠানে অংশ নেন। যে শিবকে সারা বছর আগলে রাখেন ব্রাহ্মণেরা, গাজনের ক’দিন সেই শিব সমাজের নিম্ন কোটির মানুষের হাতে পুজো গ্রহণ করেন। এখানে কোনও ভেদাভেদ নেই, জাত নেই, কুল নেই, উচ্চবর্ণের অবজ্ঞা-অবহেলা নেই। এ ক’দিন সবার সমান মর্যাদা। গাজনের সময় শিব প্রকৃত অর্থে গণদেবতা।

পশ্চিমবঙ্গে চৈত্রসংক্রান্তিতে হুগলি জেলার তারকেশ্বরে তারকনাথ শিব, বর্ধমানের কুড়মুনের ঈশানেশ্বর শিব, বাঁকুড়ার এক্তেশ্বর শিবের পাশাপাশি বাংলাদেশের ফরিদপুরের কোটালিপাড়ার বুনোঠাকুর শিবের গাজন বিখ্যাত। শিবের পাশাপাশি গাজন হয় নীল, মনসা ও ধর্মঠাকুরেরও। মালদহে গাজনের নাম ‘গম্ভীরা’, জলপাইগুড়িতে ‘গমীরা’। বাংলা পাঁজি অনযায়ী, চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহ জুড়ে সন্ন্যাসী বা ভক্তদের মাধ্যমে শিবের গাজন হয়। চৈত্র সংক্রান্তিতে চড়ক পূজার সঙ্গে এই উৎসবের সমাপ্তি ঘটে। ধর্মের গাজন সাধারণত বৈশাখ, জৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসে পালিত হয়। চৈত্রমাস ছাড়া বছরের অন্য সময় শিবের গাজন অনুষ্ঠিত হলে তাকে 'হুজুগে গাজন'ও বলা হয়। গাজন সাধারণত তিনদিন ধরে চলে। এই উৎসবের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল মেলা। 

কথায় বলে, অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট।  একটা সময় ছিল, যখন আধিক্য ছিল গাজনের সন্ন্যাসীদের। কিন্তু বর্তমান এই সময়ে হারিয়ে যেতে বসেছে গাজন উত্‍সব বা চড়ক সংক্রান্তির মেলা-ই। স্মার্ট ফোন আর ওয়েব দুনিয়ার হাতছানির মধ্যেও ডিজিটাল সময়ে কোনওক্রমে টিকে আছে শিবের গাজন।



No comments:

Post a Comment

Popular Posts

বাংলার ঘরে ঘরে আজ শিবরাত্রি পুরাণ মতে, শিবকে পতি রূপে পাওয়ার জন্য রাত জেগে উপবাস করে শিবের আরাধনা করেছিলেন দেবী পার্বতী৷ তারপর থেকেই ...