মানালির পথে - ৪
মেঘ-পাহাড়ের কোলে সুন্দরী সোলাং
সিমলা থেকে মানালি যেতে গোটা একটা দিন রাস্তাতেই কেটে গিয়েছে। তবে তার জন্য দুঃখ নেই। কারণ, অসাধারণ ছিল জার্নিটা। ২৬৫ কিলোমিটার লম্বা পথের ক্লান্তি ভুলিয়ে দিয়েছে সৌন্দর্যের ঝাঁপি উপুড় করা প্রকৃতি। আসতে আসতে দেখা হয়েছে ৭টি স্পট। ফলে, হোটেলে যখন পৌঁছলাম তখন সন্ধে প্রায় ৭টা। হোটেল বাইকে নীলকণ্ঠ। সন্ধ্যার আলোয় বাইরে থেকেই অসাধারণ দেখতে লাগছে পাইন কাঠের কারুকাজ করা হোটেলটাকে। আমাদের পৌঁছতে যে দেরি হবে, তা রাস্তা থেকেই রিসেপশনে জানিয়ে দিয়েছিলাম। ফলে, ঘরের চাবি পেতে দেরি হল না।
তিন তারা হোটেল। দামি আসবাবে সাজানো বিশাল ঘর। ঘরজুড়েও উজ্জ্বল পাইন কাঠের কাজ। বিশাল ওয়ার্ড্রোব, ড্রেসিং টেবল, টি কাউন্টার, মিনি ফ্রিজ, শরীর ডুবে যাওয়া গদিতে মোড়া সোফা, কিং সাইজের খাট। কাচের জানালার ওপাশে বারান্দা। জানালার পর্দা সরাতেই চোখে পড়ল অন্ধকার পাহাড়ের ধাপে ধাপে অসংখ্য জোনাকির আলো। আসলে জোনাকি নয়, হোটেল বা স্থানীয়দের ঘরবাড়ির আলো।
ঘুম ভাঙল সকাল ৮টায়। বিছানার ডান দিকের জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে রোদ এসে পড়ছে। পর্দা সরাতেই সামনে বিশাল পাহাড়। রাতের জোনাকিরা মুখ লুকিয়েছে দিনের আলোর গভীরে। পাহাড়ের সেই সব ধাপে তখন আপেলের বাগান। সব পাতা ঝরিয়ে বরফের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আপেল গাছের সারি।
গাড়ি আসবে সাড়ে ১০টায়। গতকাল সারাদিন জার্নি হয়েছে বলে আজ একটু দেরি করেই বেরোব। যে গাড়িতে করে সিমলা থেকে এসেছি, সেই গাড়িই রয়েছে আমাদের সঙ্গে। ২ দিন মানালিতে ঘুরিয়ে ফিরে যাবে সিমলা। মারুতি সুইফট ডিজায়ার, ৩ দিনের জন্য সাড়ে ৮ হাজার টাকা ভাড়া। স্নান-খাওয়া সেরে বড় বারান্দায় রোদপিঠ করে বসলাম সবাই। মুহূর্তে জমে উঠল পরিবারিক আড্ডা.... অমনি ঝনঝনিয়ে উঠল ইন্টারকম.... গাড়ি এসে গেছে।
নগ্গার রোডে আমাদের হোটেল। হোটেল থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে বিয়াস। গাড়ি ছুটছে সোজা ঢালু রাস্তায়। গন্তব্য সোলাং ভ্যালি। হিমাচল মানেই সিমলা... কুলু... মানালি নয়। আছে সুন্দরী সোলাং, রোটাং পাস বা ধর্মশালার মতো চোখ জুড়োন জায়গা। মানালি শহর থেকে লেহ-মানালি হাইওয়ে ধরে রোটাং পাস যাওয়ার পথে ১৪ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে সোলাং ভ্যালি। হিমাচল প্রদেশের আকর্ষণীয় জায়গাগুলির মধ্যে অন্যতম। সমুদ্র তল থেকে ৮ হাজার ৪০০ ফুট উঁচু। মানালি মল রোড থেকে গাড়িতে সময় লাগে ৩০ থেকে ৩২ মিনিট। রোটাং পাস খোলা থাক বা না থাক, ফেরাবে না সোলাং ভ্যালি। তাই সব সময় জমজমাট থাকে এই উপত্যকা। কুলু জেলার সোলাং ভ্যালি অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের স্বর্গরাজ্য। পাহাড়ের চূড়া ছুঁয়ে ঘন জঙ্গলের মাথার ওপর দিয়ে ডানা মেলে পাখির মতো ওড়ার মজাই আলাদা! সোলাং
ভ্যালির পাশাপাশি, অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের জন্য বিখ্যাত নারকাণ্ডা এবং কুফরিও।
গাড়ি থেকে নামতেই ছেঁকে ধরলেন ঘোড়ার সহিসরা। রেট কুফরির মতোই। একটি ঘোড়ায় একজন, ৫০০ টাকা। যে সহিস আমাদের ছেঁকে ধরলেন, তাঁর বয়সটা একটু কম। বয়সের সুযোগ নিয়ে আমরাও তাঁকে পাল্টা ছেঁকে ধরলাম। শেষমেশ রফা হল আমাদের দাবি মতো। ৩টি ঘোড়ায় ৪ জন, ১২০০ টাকা। কুফরির মতো এখানেও সব ঘোড়ার লাগাম বাঁধা হল একসঙ্গে। সামনের ঘোড়ায় ছেলে ও মেয়ে। মাঝের ঘোড়ায় স্ত্রী, পিছনে আমি। সবার আগে লাগাম হাতে সহিস। খুদেদের ঘোড়ার দিকে তাঁর বাড়তি সতর্ক নজর। পাথুরে পথে খটাখট খটাখট শব্দ করতে করতে পাহাড়ে চড়তে শুরু করল তিন ঘোড়া। সামনে পিছনে পাশে আরও আনেকগুলি। কেউ চড়ছে, কেউ বা নামছে। সোলাং এবং কুফরিতে এখনও বেশ জাঁকিয়ে আছে পরিবহণের পুরনো এই মাধ্যম। চড়াই পাথুরে রাস্তায় ঘোড়ার পিঠে বেশ লাগছে!
সোলাং ভ্যালির পরিচিতি ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চার ভ্যালি’ নামে। পাথুরে জলাধারের কিনারায় পাথুরে ঘরবাড়ি। পাইন বনের আড়ালে পাহাড়ের উপত্যকায় কী অসাধারণ সব গ্রাম। মাথার ওপর চক্কর কাটছে গ্লাইডার.... একটা দু’টো প্যারাশ্যুটও চোখে পড়ছে। পাশ দিয়ে ধুলো উড়িয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে স্নো স্কুটার। ঘোড়ার চালে চলেছি আমরা। যত ওপরে উঠছি, ততই কাছে আসছে বরফের সাদা মুকুট পরা পাহাড়ের সারি। পাশ দিয়ে কলকল করে বয়ে যাচ্ছে সুন্দরী
ঝরনা।
সোলাং ভ্যালির স্থানীয় নাম, ‘সোলাং নালা’। আর একটি নাম ‘স্নো পয়েন্ট’। ‘সোলাং’ শব্দের অর্থ কাছাকাছির কোনও গ্রাম। ‘সোলাং নালা’র মানে, বয়ে চলা নালার কাছাকাছি গ্রাম। সোলাং গ্রাম ও বিয়াস কুণ্ডর মাঝে সোলাং ভ্যালি। হিমবাহ ও বরফ ঢাকা শ্বেতশুভ্র পাহাড় দেখার আদর্শ জায়গা। বর্ষায় বা শরতে সবুজ সোলাং। শীতে বরফ-সাদা। কিন্তু এবার ডিসেম্বরেও মানালিতে বরফ নেই। কিন্তু তাও সে সুন্দর, অনবদ্য। চারপাশে উঁচু পাহাড়... মাঝে উপত্যকা। পাহাড়ের গায়ে পাইন, চেস্ট নাট আর স্প্রুস গাছের সারি। মাথার ওপর নীল আকাশ। পেঁজা তুলোদের সঙ্গে ভেসে বেড়ানো রংবেরঙের গ্লাইডার।
শীতের সোলাং অন্য রকম। শীতে এখানে জমে ওঠে উইন্টার স্পোর্টস। প্যারাগ্লাইডিং, প্যারাশুটিং, স্নো স্কুটার, জর্বিং, স্কিয়িং, কেবল কার, রোপ ওয়ে, হর্স রাইডিং, মিনি খোলা জিপ - কী নেই! যাঁরা স্কি করতে ভালবাসেন, তাঁদের কাছে শীতের সোলাং আদর্শ। শীতের সময় এখানকার স্কি প্রতিযোগিতা বিখ্যাত। অংশ নিতে ছুটে আসেন বহু দেশি-বিদেশি পর্যটক। শীতের শেষে যখন বসন্ত আসে, তখন গলতে শুরু করে বরফ। আর তখন স্কিয়িং-এর জায়গা নেয় জর্বিং। একটি রবারের বলের মধ্যে ২ জন। ২০০ থেকে ২৫০ মিটার ওপর থেকে গড়িয়ে দেওয়া হয় বরফ ঢাকা ঢালে। স্কিয়িং-এর সেরা সময় জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি। জর্বিং মে থেকে নভেম্বর। বর্ষা ছাড়া সারা বছরই করতে পারবেন প্যারাগ্লাইডিং। অগাস্ট থেকে অক্টোবরের মধ্যে গেলে কেবল কারে করে পাহাড়ের মাথায় অবশ্যই চড়বেন। পাহাড়ের
মাথায় দাঁড়িয়ে দেখা উপত্যকার প্যানোরামিক ভিউ আর ধৌলাধার পর্বতশ্রেণি কোনও দিন ভুলতে পারবেন না।
শতাধিক সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতেই ...! ছবি - লেখকের তোলা |
ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি
কীভাবে যাবেন -
কলকাতা থেকে বিমানে দিল্লি বা চণ্ডীগড়। সেখান থেকে বাসে বা গাড়িতে মানালি। কলকাতা থেকে ট্রেনে কালকা হয়েও যেতে পারেন। কালকা থেকে মানালি সরাসরি গাড়ি পাবেন। সিমলা দেখা না হয়ে থাকলে কালকা থেকে টয় ট্রেনে সিমলা। সিমলা থেকে গাড়িতে মানালি। চাইলে সিমলা থেকে বাসেও মানালি যেতে পারেন। কিন্তু বাসে গেলে একটা সমস্যা। মানালি যাওয়ার পথে কুলু, মাণ্ডি, রাফটিং পয়েন্ট, প্যাণ্ডো ড্যাম, সুন্দরনগর লেক, গুরুদ্বারের মতো জায়গায় বাস থামবে না। গাড়িতে গেলে এইসব জায়গাগুলো দেখা যাবে।
কোথায় থাকবেন -
সোলাং-এ হোটেল হাতে গোণা। তাই সবাই মানালিতে থেকে সোলাং ভ্যালি বা রোটাং পাস ঘুরে আসেন। তবে থাকতে চাইলে পাবেন হোটেল বা রিসর্ট।
- Subscribe: https://www.youtube.com/c/RAJATKANTIBERA
- Blog: https://rajatkb.blogspot.com
- Google Plus: https://plus.google.com/u/0/
- Linkedin: https://www.linkedin.com/in/rajatkanti-bera-275134139/
- Facebook: https://www.facebook.com/rajatkanti.bera
© All rights of this article and this BLOG reserved for RAJATkanti BERA. Unauthorized use or reproduction of any cause is strictly prohibited.
No comments:
Post a Comment