পয়লা বৈশাখ বা অক্ষয় তৃতীয়ায়
ঐতিহ্যের হালখাতা
হালখাতা। পয়লা বৈশাখ হোক বা অক্ষয় তৃতীয়া-বাংলা বছরের শুরুতেই খুব শুনতাম শব্দটা। তখন তো অত মানে বুঝতাম না। শুধু শুনতাম, পাঁজি মতে নাকি পয়লা বৈশাখের পর বাংলা বছরের প্রথম শুভদিন৷ বৈশাখ মাসের এই দিনটি বিশেষ ভাবে শুভ ব্যবসায়ীদের কাছে৷ বাড়ির বড়রা বিশ্বাস করতেন, বৈশাখ মাসের শুক্ল পক্ষের তৃতীয়ায় এই দিনটিতে যে ধনসম্পদ ক্রয় করা হয়, তার কোনও ক্ষয় হয় না৷ এই বিশ্বাস থেকেই পরিচিতি অক্ষয় তৃতীয়ার। শহরে বা গ্রামে পয়লা বৈশাখের পাশাপাশি, ধুমধাম করে হালখাতা হয় অক্ষয় তৃতীয়াতেও। বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই বাড়িতে বাড়িতে পাঠানো হয় ছাপানো চিঠি। আকাশি বা লাল রঙের ছাপানো চিঠির বয়ান সবারই এক। ফাঁকা জায়গায় প্রয়োজন মতো লিখে দেওয়া প্রাপক ও প্রেরকের নাম।
যখন স্কুলে পড়তাম, তখন থেকেই হালখাতা করার দায়িত্ব পড়ত আমার ওপর। বিকেল বিকেল তৈরি হয়ে নিমন্ত্রণের কার্ড হাতে হাজির হতাম মুদিখানা বা সোনার দোকানে। গ্রামের দিকে ডাক্তারখানাতেও চলে ধারবাকি। ফলে, হালখাতা হয় ডাক্তারখানাতেও। মোটা লাল কাপড় দিয়ে বাঁধানো লম্বা নতুন খাতার প্রথম পাতায় তেল-সিঁদুর মাখানো এক টাকার কয়েনের ছাপ। সঙ্গে স্বস্তিক চিহ্ন। পরের পাতা থেকে শুরু নতুন হিসেব। সারা বছর যেখানে চূড়ান্ত অগোছালো ছাপ, পয়লা বৈশাখ বা অক্ষয় তৃতীয়াতে সেখানেই সব সাজানো গোছানো। ধারে জিনিস কেনা বা ধারে ওষুধ খাওয়ার জন্য যেখানে সারা বছর দোকানদার বা ডাক্তারের ব্যাজার মুখ সহ্য করতে হয়, হালখাতার দিন সেখানেই খাতিরের খামতি নেই। সুন্দর করে সাজানো দোকান.... ডাক্তারখানা....সামনে সার দিয়ে পাতা লাল রঙের প্লাস্টিকের চেয়ার... সামনে পিছনে বড় বড় স্ট্যান্ড ফ্যান। ভেতরে শালু কাপড়ে ঢাকা চৌকি পেতে বসেছেন মালিক। চৌকির পাশেই লক্ষ্মী বা গণেশের ছবি। ধার-বাকি সব আদায় হবে, এই আশায় মালিকের ঠোঁটে চওড়া হাসি। তখন ঠান্ডা পানীয় চল ততটা হয়নি। চেয়ারে গিয়ে বসতে না বসতেই হাতে এসে যেত রঙিন শরবতের গ্লাস। গ্লাস শেষ করে, পকেটের কোণে দুমড়ে-মুচড়ে থাকা একশো টাকার নোটটা এগিয়ে দিতেই সব হাসি উধাও! আসলে, বাকির অঙ্ক হয়তো হাজার ছাড়িয়েছে! মাত্র একশো টাকা আদায়ে কার আর মনের অবস্থা ভাল থাকে! তবুও কোনওমতে শুকনো হাসির রেশ ঠোঁটের কোণে ধরে রেখে, ঘরে তৈরি বোঁদে আর মিস্টি গজার প্যাকেটের সঙ্গে বাংলা ক্যালেন্ডার এগিয়ে দিতেন।
৭-৮টা দোকানে হালখাতা। ৭-৮টা ক্যালেন্ডার। বড়রা হিসেব করতেন ক্যালেন্ডার নিয়ে, লক্ষ্মী না গণেশ-- কোন ছবিটা সুন্দর, কোন ছবিটা বাঁধানো যাবে। আমাদের ছোটদের নজর থাকত মিস্টির প্যাকেটে। যত প্যাকেট, তত আনন্দ! দোকানদারের শুকনো হাসির সেই অবহেলাও সেই আনন্দের কাছে ম্লান হয়ে যেত।
গ্রামের সেই আমি এখন কলকাতাবাসী। প্রায় ৩০ বছর পর গত পয়লা বৈশাখ পরিবারের সঙ্গে গিয়েছিলাম হালখাতা করতে। চিঠি নয়, নিমন্ত্রণ এসেছিল মোবাইল ফোনে। দোকানে হাজির হতেই হাতে কোল্ড ড্রিঙ্ক। কড়কড়ে একটা পাঁচশো টাকার নোট এগিয়ে দিতেই দোকানদারের চওড়া হাসি। উল্টো দিক থেকে হাতে এল হালখাতা প্যাকেজ- রিটার্ন গিফট, নামী দোকানের মিস্টি, কেক, চানাচুর, চিপস, ক্যালেন্ডার! মোটামুটি ৩-৪টি দোকানে হালখাতা করলেই ফ্রিজ উপচে পড়ে মিস্টিতে! যে সব দোকানে হালখাতা হয় না, পয়লা বৈশাখ বা অক্ষয় তৃতীয়ায় মিস্টির ব্যবস্থা সেখানেও। কোনও অছিলায় কিছু একটা কিনলেই হল, হাতে মিস্টির প্যাকেট। কিছু না কিনলেও মিলতে পারে মিস্টি। বাঘাযতীন বাজারের বহু পুরনো দোকান ‘গীতা স্টোর্স’-এ তো লাইন পড়ে বিনা পয়সায় মিস্টির প্যাকেট নেওয়ার জন্য। অনেকে তো পরিবারের ৩-৪জনকে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন।
বাংলা বছরের প্রথম দিন, বাংলা নববর্ষ। দিনটি বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে শুভ নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সঙ্গে পালিত হয়।ত্রিপুরার বাঙালিরাও পালন করেন এই উৎসব। সে হিসেবে এটি বাঙালির সর্বজনীন উৎসব। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৪ এপ্রিল অথবা ১৫ এপ্রিল পয়লা বা পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। তবে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ এপ্রিলই দিনটি পালিত হয়।
- Subscribe: https://www.youtube.com/c/RAJATKANTIBERA
- Blog: http://rajatkb.blogspot.com
- Google Plus: https://plus.google.com/u/0/
- Linkedin: https://www.linkedin.com/in/rajatkanti-bera-275134139/
- Facebook: https://www.facebook.com/rajatkanti.bera
No comments:
Post a Comment