মানালির পথে-৫
বশিষ্ঠ কুণ্ডে উষ্ণ প্রস্রবণে ডুব!
আজকের গন্তব্য বশিষ্ঠ মুনির মন্দির। যেখানে সেই বিখ্যাত উষ্ণ প্রস্রবণ। মানালির বিখ্যাত জায়গাগুলির একটি। বাসস্ট্যান্ড থেকে মাত্র সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে বশিষ্ঠ মুনির মন্দির। গাড়ি নিতে না চাইলে মল রোড থেকে অটো নিতে পারেন। চাইলে হেঁটেও যাওয়া যায়, ট্রেকিং-এর স্বাদ পাওয়া ও ঋষি দর্শন দুই-ই হবে। আমাদের গাড়ি যত এগোচ্ছে ততই খাড়া হচ্ছে রাস্তাটা। সামনে একটা অটো তিন-চারজন পর্যটক পেটে পুরে কোনও মতে নিজেকে ওপরের দিকে টেনে নিয়ে চলেছে। কলকাতার মতো গ্রিন অটো নয়, কালো অটো, কালো ধোঁয়া। পাহাড়ে পরিবেশ দূষণ!
গ্রামের নাম বশিষ্ঠ। কারণ, এখানে রয়েছে বশিষ্ঠ মুনির মন্দির। হিন্দু ধর্মের সাত ঋষির এক ঋষি, রঘুবংশের কুলগুরু বশিষ্ঠ। পাহাড়ের মাথায় গাড়ি গিয়ে দাঁড়াল একটা চাতালে। সেখানে অনেকগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে। ডিসেম্বরের শেষ, এখন পিক সিজন। পর্যটকদের ভিড়ে ঠাসা মানালি। পার্কিং থেকে মন্দির বেশ কিছুটা চড়াই পথ। যেতে হয় হেঁটে। কিছুটা করে ঢালু রাস্তা, তারপর কয়েকটা সিঁড়ি। রাস্তার দু’পাশে প্রচুর শালের দোকান, ফল-কাজু-আখরোট-খেজুরের পসরা নিয়ে বসেছেন মহিলারা। কেউ বা দাঁড়িয়ে অতিকায় খরগোস হাতে। কোলে নিয়ে ছবি তুললেই ২০ টাকা।
কথিত আছে, ঋষি বিশ্বামিত্রর হাতে তাঁর সন্তানরা নিহত হয়েছে, এই খবর জানতে পেরে প্রাণ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন ঋষি বশিষ্ঠ। নদীতে ডুবে প্রাণ ত্যাগ করতে চান তিনি। কিন্তু পাহাড়ি নদী তাঁর প্রাণ নিতে অস্বীকার করে। বশিষ্ঠর প্রাণ না নিয়ে তাঁকে প্রতিজ্ঞা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য সেই নদীর নাম হয় বিপাশা। যার মানে, ফ্রিডম ফ্রম বন্ডেজ। প্রতিজ্ঞামুক্ত হয়ে বিয়াস বা বিপাশা নদীর তীরেই ধ্যানমগ্ন হন মুনি বশিষ্ঠ। বিপাশা নদীর ধারে পাহাড়ের মাথায় প্রকৃতির মাঝে গড়ে ওঠে মন্দির।
আনুমানিক ৪০০০ বছর আগে তৈরি হয় মন্দিরটি। বিশেষ আকর্ষণ, অসাধারণ কাঠের কারুকাজ আর নির্মাণ শৈলী। চারপাশের ঘরবাড়ির মতো মন্দিরেও প্রাচীন ছাপ। এত হাজার বছর ধরে বশিষ্ঠ গ্রাম তার ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে। গর্ভগৃহে কালো কষ্টি পাথরের বশিষ্ঠ মুনির মূর্তি। ভেতরের দেওয়ালে কাঠের কারুকাজ ও অসংখ্য ছবি।
আশেপাশে আরও কয়েকটা মন্দির। পাশে একটা পাথরের দেওয়ালে পাথুরে বেসিনে পিতলের কল। কল খুললেই বাষ্প ওঠা গরম জল। উষ্ণ প্রসবণের জল। কিন্তু কোথা থেকে এল এই গরম জল? তা নিয়েও প্রচলিত আছে কাহিনি। কথিত আছে, ঋষি বশিষ্ঠকে স্নান করার জন্য বহুদূর হেঁটে যেতে দেখে লক্ষ্মণ মাটিতে তীর নিক্ষেপ করেন। পাথুরে মাটি ফেটে বেরিয়ে আসে গরম জলের ধারা। সেই উষ্ণ প্রস্রবণের ধারাই বিখ্যাত করেছে মানালিকে। কথিত আছে আরও একটি কাহিনি। একবার লক্ষ্মণ গুরুদেব বশিষ্ঠের সঙ্গে দেখা করতে এসে দেখেন, এখানকার জল খুব ঠান্ডা। গুরুর এই ঠান্ডা জলে স্নান করতে কষ্ট হয় ভেবে লক্ষ্মণ তাঁর অগ্নিবাণ দিয়ে পাথরে গর্ত করে গরম জলের চিরস্থায়ী ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু বশিষ্ঠ তো ঋষি, সন্ন্যাসী মানুষ, গরম জল তাঁর কাছে বিলাসিতা। তবে লক্ষ্মণের গুরুভক্তি দেখে তিনি আশীর্বাদ করেন, এই জল চিরকাল এরকমই গরম থাকবে ও এই জলে একবার স্নান করলে যে কোনও রোগ, বিশেষ করে চর্মরোগ ভাল হবে। সেই থেকে বিশ্বাস, এই কুণ্ডের জলে স্নান করলে পাপমুক্ত হওয়া যায়। সেরে যায় যে কোনও চর্মরোগ। আসলে, প্রস্রবণের জলে আছে সালফার বা গন্ধক। যার জন্যই ভাল হয় চর্মরোগ।
পুরুষ ও মহিলাদের জন্য উষ্ণ প্রস্রবণের জলে আলাদা আলাদা স্নানের ব্যবস্হা আছে। পর্দা সরাতেই একটা গভীর চৌবাচ্চা। চারপাশ বাঁধানো ছোটোখাটো একটা পুকুরের মতো। ঠিক যেন হরপ্পা সভ্যতার স্নানঘর। তীর্থক্ষেত্রে এই ধরনের স্নানের জায়গাকে কুণ্ড বলে। জামা-কাপড় খুলে স্নানের পোশাক পরে জলে হাত দিলাম। সহনীয় উষ্ণতা। সবাই মিলে নামলাম বশিষ্ঠ কুণ্ডের জলে।
- Subscribe: https://www.youtube.com/c/RAJATKANTIBERA
- Blog: https://rajatkb.blogspot.com
- Google Plus: https://plus.google.com/u/0/
- Linkedin: https://www.linkedin.com/in/rajatkanti-bera-275134139/
- Facebook: https://www.facebook.com/rajatkanti.bera
© All rights of this article and this BLOG reserved for RAJATkanti BERA. Unauthorized use or reproduction of any cause is strictly prohibited.
No comments:
Post a Comment